জাতীয় ডেস্ক
রাজধানীতে আয়োজিত একটি জাতীয় কর্মশালায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে দেশের কৃষিজমি উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, এসব প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের ওপর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আজ সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার’ বিষয়ক জাতীয় কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা বলেন, কৃষিজমির ওপর চাপ বাড়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, অস্বাভাবিক আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং জলবায়ুজনিত ঝুঁকি নতুন নতুন রোগবালাই ও পোকামাকড়ের বিস্তার ঘটাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিকভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি অনুসরণের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। পূর্বে একটি জমিতে একাধিক ধরনের ফসল উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে মাটির গুণগত পরিবর্তন ও অনুকূল পরিবেশের অভাবে ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। উপদেষ্টা আরও বলেন, কৃষিতে কীটনাশকের পাশাপাশি অতিরিক্ত হার্বিসাইড ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব শুধুমাত্র কৃষি খাতেই সীমাবদ্ধ নেই; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতও সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
মৎস্য খাতের প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, অ্যাকুয়াকালচারের উন্নতির ফলে মাছের উৎপাদন বেড়েছে, তবে এটি প্রাকৃতিক জলাশয়ের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। একসময় দেশের ৬০ শতাংশ মাছ পাওয়া যেত উন্মুক্ত জলাশয় থেকে, কিন্তু বর্তমানে চিত্রটি উল্টো। উন্মুক্ত জলাশয়ে দূষণ, ভরাট, নাব্যতা হারানো এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন কার্যক্রম মাছের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে দেশীয় মাছের বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
কর্মশালায় উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, কৃষি এখনো দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১১ শতাংশের উৎস এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশের জীবিকা কৃষিনির্ভর। কিন্তু দেশের ৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমি দ্রুত কমে আসছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, অবকাঠামো সম্প্রসারণ এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের কারণে। বক্তারা বলেন, এভাবে কৃষিজমি হারাতে থাকলে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
তারা আরও উল্লেখ করেন, ভূমি দখল, অতিরিক্ত বেসরকারীকরণ, রাসায়নিক দূষণ এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব কৃষিজমির জন্য বড় হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কৃষিজমি সুরক্ষায় সরকারের প্রস্তাবিত আইনের কার্যকর বাস্তবায়নকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। বক্তারা বলেন, নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, ভূমি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট মানচিত্রায়ন, কৃষিজমিকে শিল্প বা আবাসিক ব্যবহারের বাইরে রাখা এবং টেকসই কৃষি-পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি।
কর্মশালায় কৃষি, ভূমি, পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অংশীজনরা অংশ নেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, কৃষিজমি সুরক্ষায় সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। তারা কৃষকের জমি রক্ষায় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা হালনাগাদ রাখা, রাসায়নিক ব্যবহার কমানো এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, কৃষিজমি রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। জলাশয় সংরক্ষণে কঠোর নজরদারি না থাকলে মৎস্যসম্পদ হ্রাসের প্রবণতা আরও বাড়বে, যা দেশের খাদ্যব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তারা ভূমি ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী নীতিমালা গ্রহণ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুপারিশ করেন।