জাতীয় ডেস্ক
সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে এবং একই সময়ে নতুন করে ৫৬১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, নতুন তথ্য যুক্ত হওয়ায় চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ জনে এবং এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৯৭ হাজার ৮২৯ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকা মহানগরী এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি। সর্বোচ্চ সংখ্যা দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়, যেখানে ১২৭ জন রোগী নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ভর্তি হয়েছেন ৭৫ জন। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৬ জন, বরিশাল বিভাগে ৪৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৮ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩১ জন, খুলনা বিভাগে ছয়জন, রংপুর বিভাগে পাঁচজন এবং সিলেট বিভাগে তিনজন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে যেসব দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, দুজনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা। মৃত্যুর ধরন ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আলাদাভাবে সংগ্রহ করছে। চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তি এবং সহ-অসুস্থতা থাকা রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি তুলনামূলক বেশি দেখা গেছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অব্যাহত সংক্রমণের মধ্যেও রোগী সুস্থ হওয়ার হার উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৪০ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন মোট ৯৫ হাজার ৭৪৪ জন। তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—নতুন আক্রান্তের প্রবাহ এখনও উল্লেখযোগ্য, যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও মৃত্যুহার এখনও উল্লেখযোগ্য। ২০২৪ সালে দেশের হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন ডেঙ্গু রোগী এবং মারা যান ৫৭৫ জন। এর আগের বছর ২০২৩ সালে রেকর্ডসংখ্যক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০৫, যা দেশে ডেঙ্গু ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে মৌসুমি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। শহরাঞ্চলে আবাসিক ভবন, নির্মাণাধীন স্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি জমে থাকা স্থানগুলো এডিস মশার প্রজননের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত। সংক্রমণ ঋতুভিত্তিক হলেও, গেল কয়েক বছর ধরে এডিস মশার বিস্তার দীর্ঘ সময়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বর্ষা মৌসুমের বাইরে গিয়েও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, নগর এলাকায় দ্রুত নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অনিয়ন্ত্রিত পানি জমে থাকা পরিস্থিতি ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়াতে সহায়তা করে। তাই স্থানীয় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও নাগরিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গুর প্রকোপ টেকসইভাবে কমানো সম্ভব নয়। তারা নিয়মিত বাসাবাড়ি, আশপাশের অব্যবহৃত পাত্র, ছাদ, ড্রেন ও বাগানে জমে থাকা পানি অপসারণের ওপর জোর দিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোতে শয্যা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত, বিশেষায়িত ইউনিট গঠন এবং চিকিৎসাকর্মীদের অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য রোগীর চাপ বিবেচনায় প্রতিদিনই পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে যে সংক্রমণের ঝুঁকি এখনও বহাল রয়েছে এবং প্রতিদিন নতুন রোগী বৃদ্ধির হার পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাপ কমাতে এবং সম্ভাব্য সংক্রমণের বিস্তার রোধে নাগরিক সচেতনতা ও স্থানীয় পর্যায়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমন্বিত উদ্যোগ ও নিয়মিত নজরদারি জোরদার করা গেলে ভবিষ্যতে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।