স্বাস্থ্য ডেস্ক
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন উদ্বেগজনক রূপ ধারণ করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে এবং একই সময়ে ১২০ জন নতুন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৭৯৩ জনে এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ১২০ জন রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ জন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এবং ১৮ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬ জন, খুলনা বিভাগে ৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ১ জন এবং সিলেট বিভাগে ২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১ হাজার ৬৮৮ জন রোগী চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। যদিও ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, তবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতিকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
চলতি বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণের ধারা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে ৬২.৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭.৫ শতাংশ নারী। সংক্রমণের এই লিঙ্গভিত্তিক অনুপাত ইঙ্গিত দেয় যে, পুরুষদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে বাইরে দীর্ঘসময় অবস্থান, চলাচলের ঘনত্ব এবং সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার কম ব্যবহার পুরুষদের আক্রান্তের হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে।
এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণঘাতী ও বিস্তৃত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও ঢাকা শহরের বাইরের অঞ্চলে রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, যা স্থানীয় পর্যায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ঘাটতি ও জনসচেতনতার অভাবকে সামনে আনছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন মৌসুম সাধারণত বর্ষাকালে সক্রিয় হলেও, চলতি শীত মৌসুমেও সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোলরুম সূত্র জানায়, সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বিশেষ ওয়ার্ড, স্যালাইন সরবরাহ, রক্তের প্লাটিলেট প্রস্তুত রাখা এবং মেডিকেল টিম সক্রিয় রাখা হয়েছে। তবে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় মানবসম্পদ, বেড সংকট এবং রোগ নির্ণয় ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার মতো চ্যালেঞ্জও তৈরি হচ্ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সাধারণত উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে তীব্র ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, বমি ভাব, র্যাশ এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা যায়। জটিল পর্যায়ে রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, রক্তবমি, মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করছেন, লক্ষণ দেখা দিলেই অবহেলা না করে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে এবং বাসাবাড়ির আশপাশে মশার উৎস ধ্বংসে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞরা তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন:
১) এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা,
২) ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা (মশারি, রিপেলেন্ট, ফুল হাতা পোশাক),
৩) স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের সমন্বিত মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা।
পরিবেশবিদদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি এবং গৃহস্থালি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব এডিস মশার বিস্তারকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে জনগণের অংশগ্রহণ ও আচরণগত পরিবর্তন ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সফলতা পাওয়া কঠিন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলরুম ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় রয়েছে এবং জেলা–উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু চিকিৎসা সমন্বয়ে মনিটরিং টিম কাজ করছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন আর কেবল মৌসুমি রোগ নয়, এটি সারাবছরের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু—দুটিই দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় সতর্কবার্তা। সংক্রমণ কমাতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ, দ্রুত রোগ নির্ণয়, জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও কার্যকর করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক আচরণ নিশ্চিত করা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।