মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রামআলোচিত-সমালোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নামে প্রতি বছর সংগ্রহ করা হয় শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা এসব টাকার কিছু অংশ অর্থায়ন করা হয় নাশকতার কাজে। বাকি সিংহভাগ টাকাই লুটপাট করেন সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সংগঠন থেকে লুট করা এসব টাকা দিয়ে একেক নেতা বনে গেছেন কোটিপতি। করেছেন বাড়ি-গাড়ি। অনেকে আবার বিদেশেও বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হেফাজতের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে সংগঠনটির অর্থ সংগ্রহের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তে জানা গেছে কিছু অর্থ জোগানদাতার নামও। বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’
চট্টগ্রাম পুলিশের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নামে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিবছর শত কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। এসব টাকা থেকে কিছু অংশ ব্যয় করা হয় সংগঠন পরিচালনা ও নাশকতার কাজে। বাকি টাকা চলে যায় নেতাদের পকেটে। এসব টাকা মেরে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে এখন কোটিপতি। গড়েছেন অভিজাত বাড়ি। কিনেছেন গাড়ি। কেউ কেউ আবার বিদেশেও বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন খাতে।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক ব্যয় নির্বাহ, নিহত ও নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের সাহায্যের নামে প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে শত কোটি টাকা সংগ্রহ করেন শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এর সিংহভাগ অর্থের জোগান দেন ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের কয়েকজন প্রবাসী। এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি ৩০ ব্যক্তির একটি তালিকা তৈরি করেছে প্রশাসন, যারা প্রতিবছর হেফাজতে ইসলামের জন্য সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা ডোনেট করে থাকেন। হেফাজতে ইসলামের এ ডোনারদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকার মিটফোর্ডের ব্যবসায়ী মো. মুনির হুসায়ন, হাজী মো. শাহজাহান, হাজী আহমদ, মো. ফয়সাল, ঢাকা সিটি সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের আবদুর রাজ্জাক, গুলশানের কবির মহিউদ্দিন, বনানীর জাহিদুল হাসান, জাকের সুপার মার্কেটের ইব্রাহিম খলিল, ডা. মো. ইশতিয়াক আহমদ, আবদুল মালেক সিকদার প্রমুখ। তারা একেকজন বছরে ১ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা দেন হেফাজতে ইসলামকে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার ব্যবসায়ী মো আইয়ুব দেন ৫ কোটি টাকা, হাটহাজারীর মোহাম্মদ ইকবাল দেন ৩ কোটি টাকা, রাজা মিয়া কন্ট্রাকটর দেন ১ কোটি টাকা, মো. ফরিদ দেন ১ কোটি টাকা। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের অর্থের বড় একটি জোগান আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে, যার মধ্যে মো. জসিম উদ্দিন দুবাই থেকে সংগ্রহ করে দেন ৫ কোটি টাকা, আহসান উল্লাহ মাস্টার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে দেন ৫ কোটি টাকা, হাফেজ আলী আজম সৌদি আরব থেকে সংগ্রহ করে দেন ১০ কোটি, মো. আনোয়ার সৌদি আরব থেকে সংগ্রহ করে দেন ৫০ লাখ, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ী আবুল কাসেম সংগ্রহ করে দেন ১০ কোটি, ইলিয়াস তালুকদার মধ্যপ্রাচ্য থেকে সংগ্রহ করে দেন ৫ কোটি, মাওলানা মো. ফারুক কাতার থেকে সংগ্রহ করে দেন ৫ কোটি টাকা। স্থানীয়ভাবে ১০ লাখ টাকার ওপরে দেন এমন ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাটহাজারীর আবদুল্লাহ আল মামুন দেন ৫০ লাখ টাকা, তসবি জাহাঙ্গীর ৫০ লাখ টাকা, ওমর ফারুক দেন ৫০ লাখ টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের এক নেতা বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নেতারা নিহত, নির্যাতিত ও দুস্থ নেতা-কর্মীদের সহায়তার নামে টাকা সংগ্রহ করেন। রোজা ও কোরবানির আগে সবচেয়ে বেশি টাকা সংগ্রহ করেন তারা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ আসে কমপক্ষে ৩০ দেশি-বিদেশি ডোনারের কাছ থেকে। ২০১৩ সালের পর থেকে হেফাজতে ইসলাম টাকা সংগ্রহ করছে। শুরুতে নিয়ম ছিল, যিনি টাকা সংগ্রহ করবেন তিনি ২০ শতাংশ রেখে বাকি টাকা সংগঠনকে দেবেন। কিন্তু এখন ৮০ শতাংশ টাকা নিজের কাছে রেখে আত্মসাৎ করেন নেতারা।’