সাহাদাত হোসেন পরশ
বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার সূত্র ধরে নারী পাচারের ভয়ংকর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাচার করা নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। একটি সংঘবদ্ধ চক্র ফাঁদ পেতে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে পাঁচ হাজার মেয়েকে। ভারতে পাচার হওয়া নারী প্রায় সবাইকে পাঠানো হয়েছে অবৈধভাবে সাতক্ষীরা, বেনাপোল ও বুড়িমারী সীমান্তপথে।
এর আগে গত বছর দুবাইকেন্দ্রিক নারী পাচারের একটি শক্তিশালী চক্রের তথ্য ফাঁস হয়। ওই চক্রের মূল হোতা আজম খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। তবে তার দুই ভাই মো. নাজিম ও এরশাদ বিদেশে পলাতক। চাকরি দেওয়ার কথা বলে কয়েকশ তরুণীকে দুবাই নিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করেন আজম। দুবাইয়ে ৪টি বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে তার। আজমের পর এবার ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক নারী পাচারের আরেকটি বড় সিন্ডিকেটের তথ্য সামনে এলো।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সীমান্ত পাড়ি দিতে জনপ্রতি অন্তত ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। নারী পাচারের এই চক্র সক্রিয় পাঁচ বছর ধরে। বাংলাদেশি তরুণীদের বিদেশে ভালো চাকরি ও টিকটকের নায়িকা তৈরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছিল। এই চক্রের অন্যতম হোতাসহ কয়েকজন পুলিশ-র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। যে কোনো সময় তারা গ্রেপ্তার হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা গতকাল রোববার সমকালকে এ তথ্য জানান।
এদিকে, এক তরুণীর নিপীড়নের ভিডিও প্রকাশের পর রেশ না কাটতেই খোঁজ মিলেছে আরও ছয় তরুণীর ভিডিওর। ধারণা করা হচ্ছে, তারাও ভারতের বেঙ্গালুরুতে কোনো গোপন আস্তানায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। প্রথম ভিডিওতে নির্যাতনের শিকার তরুণী ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা। নতুন দুটি ভিডিওতে যেসব তরুণীকে দেখা গেছে, তারাও বাংলাদেশি নাগরিক বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
প্রথম ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সূত্র ধরে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক বাবুসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ। তাদের মধ্যে দু’জন পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। যৌন নিপীড়নের শিকার ওই তরুণীকেও কেরালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েটির মেডিকেল পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের ১৪ দিনের হেফাজতে নিয়েছে ভারতীয় পুলিশ।
এদিকে, এ ঘটনায় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার রাতে হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা বাদী হয়ে টিকটক হৃদয়সহ অজ্ঞাত আরও চারজনকে আসামি করে পর্নোগ্রাফি ও মানব পাচার আইনে মামলা করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ এ চক্রের সদস্যদের শনাক্ত কাজ শুরু করেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, কারা কীভাবে প্রথম এসব ভিডিও ভাইরাল করেছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, টার্গেট করা তরুণীদের টোপ দিয়ে প্রথমে সীমান্ত এলাকায় নেওয়া হয়। পরে দালালদের মাধ্যমে বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় তাদের ভারতে নেওয়া হয়। এসব তরুণীকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে বিক্রি করা হচ্ছে। অহিও নামে একটি হোটেলে অনেক যৌনকর্মী রয়েছেন, যারা বাংলাদেশি।
অন্য এক কর্মকর্তা জানান, ভারত থেকে এরই মধ্যে কয়েক তরুণী পালিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন। তারা গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বেঙ্গালুরু পর্যন্ত পৌঁছতে অন্তত সাতবার হাত বদল হন তারা। সীমান্তে পৌঁছার পর তাদের পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি ঘরে রাখা হয়। সীমান্তের দু’পাশেই লাইনম্যান রয়েছে। সীমান্তে পৌঁছার পরপরই তরুণীরা বুঝতে পারেন, তারা অসাধু সিন্ডিকেটের হাতে পড়েছেন। যতবার হাত বদল করা হয়েছে, ততবারই নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাদের। চূড়ান্ত ধাপে তাদের হোটেলে বিক্রি করা হয়। সেখানে দিনের পর দিন তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এর বিনিময়ে তাদের কোনো টাকা দেওয়া হয় না। শুধু তিনবেলা খাবারের বিনিময়ে তাদের হোটেলে থেকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা হয়।
যেসব দালাল এই নারী পাচার চক্রে জড়িত, তারা পাচার হওয়া নারীদের ভিডিও তৈরি করে রাখে। কেউ পালানো ও প্রতিবাদের চেষ্টা করলে পরিবারের সদস্যদের কাছে তা পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করায় পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ারও ভয় দেখানো হয়।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিভিন্ন ঘাট রয়েছে। আলাদা ‘ইজারাদার’ রয়েছে। নারী পাচারকারীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এসব ঘাট দিয়ে পাচার করে থাকে। নারী পাচারে সীমান্তে দীর্ঘদিন সক্রিয় এমন দুই শীর্ষ ব্যক্তির নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। টিকটক বাবু ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ তরুণীদের সামনে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার টোপ ফেলে। তারপর তাদের দালালদের হাতে তুলে দেয়।
বাংলাদেশ-ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক নারী পাচারকারী এ চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম-পরিচয় পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ভারতের সবুজ নামে একজন রয়েছে এই চক্রে। বাংলাদেশের বকুল নামে একজন এই সিন্ডিকেটের সদস্য।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একেএম আক্তারুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক নারীকে ভারতে নেওয়ার পর সেখানে গিয়ে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। অনেককে উদ্ধার করে সেফ হোমে রাখা হয়। এর পর তাদের ট্রাভেল পাস দিয়ে বাংলাদেশ পাঠায়। গত ছয় মাসেই এ প্রক্রিয়ায় অন্তত ৫০ নারী দেশে ফিরেছেন। যাদের ব্যাপারে তথ্য মিলে না তারা মাসের পর মাস নির্যাতনের শিকার হন। নারী পাচারের অনেক ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারতে পৃথক মামলা হয়। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিকটিম ও আসামির ভারতে অবস্থান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আক্তারুজ্জামান আরও বলেন, নারী পাচারের ঘটনায় ১২৬টি মামলা তার ইউনিটে তদন্তাধীন। ভারতে পাচার করা হয়েছে এমন ঘটনায় মামলা আছে ১৫টি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, ভারতীয় পুলিশ এরই মধ্যে নির্যাতনের শিকার এক বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের মাধ্যমে এই নারীর ব্যাপারে তথ্য নিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। নারী পাচারের বিশেষ হোতাদের ব্যাপারেও উভয় দেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।
এদিকে বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিওতে দৃশ্যমান দু’জনকে যশোরের বাসিন্দা বলে শনাক্ত করেছেন তাদের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা।
যশোরের চাঁচড়া মধ্যপাড়ার ভ্যানচালক মনু মিয়া বলেন, ভিডিওতে রয়েছে এমন দু’জন হলো তার ছেলে আলামিন ও অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ার তানিয়া। তানিয়াকে আলামিন স্ত্রী পরিচয় দেয় বলে মনু মিয়া জানান। আলামিনকে আট মাস আগে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মনু মিয়া বলেন, আলামিনের স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়। তার কাছে সন্দেহজনক লোকজন আসত। তারা ঘরে বসেই মাদক সেবন করত। এসব কারণে তাকে ঘরছাড়া করা হয়। আলামিন ভারতে গেছে বলে জানতাম। তবে পরিবারের কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।
তিনি বলেন, ভিডিওতে আলামিন গোলাপি ফুলহাতা গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় ছিল। তার পায়ে কালো রাবারের ব্যান্ড ছিল। ভিডিওতে লাল ফুলহাতা টপস পরা মেয়েটির নাম তানিয়া। তার বাড়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায়।
আলামিনের তৃতীয় স্ত্রী শারমিন জানান, তিনি ভিডিও দেখে ঘটনা জানতে পারেন। আলামিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ভারতে। তিনি শারমিনকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে এক ছেলে আছে।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশে-বিদেশে নারী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এরই মধ্যে চক্রটির অনেক তথ্য আমাদের হাতে এসেছে।