নিজস্ব প্রতিবেদক
ভারতের মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের অনুসারীরা যে নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন, সেই ‘ডি-কোম্পানি’ নাম দিয়ে ঢাকার টঙ্গীতে গড়ে তোলা হয়েছিল কিশোর গ্যাং।
ছোটখাটো বিষয় নিয়ে লোকজনকে মারধর, মাদক বেচাকেনা, ছিনতাই, চাঁদাবাজির মাধ্যমে এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন এই গ্যাংয়ের সদস্যরা।
লন্ডনফেরত দুই ভাই রাজীব চৌধুরী বাপ্পী ওরফে লন্ডন বাপ্পী ও সজীব চৌধুরী ওরফে পাপ্পুর হাত ধরে কয়েক বছর আগে গড়ে ওঠে এই অপরাধী চক্র। সজীব চৌধুরী কয়েক মাস ধরে কারাগারে। রাজীবসহ এই চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
বিজ্ঞাপন
গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, ডিয়ারিং কোম্পানি বা ডি–কোম্পানি নামের এই গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৫০ জন। তাঁদের সবার বয়স ২৫ বছরের মধ্যে। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তাঁদের ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খুলত না। রাজীব (৩৫) এই গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রতি মাসে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁর হাতে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আসত। অপর দিকে রাজীব প্রতি সপ্তাহে গ্যাংয়ের সদস্যদের ৩০০-৫০০ টাকা করে দিতেন।
ডি কোম্পানির নেতৃত্বাদাতা রাজিব চৌধুরী বাপ্পী ওরফে লন্ডন বাপ্পী
ডি কোম্পানির নেতৃত্বাদাতা রাজিব চৌধুরী বাপ্পী ওরফে লন্ডন বাপ্পীছবি: সংগৃহীত
‘টঙ্গীতে ৩০ কিশোর গ্যাং জড়াচ্ছে নানান অপরাধে’ শিরোনামে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই ৩০ কিশোর গ্যাংয়ের একটি ডি-কোম্পানি। ফেসবুকে এই নামে তাদের একটি গ্রুপও রয়েছে।
প্রথম আলোর সংবাদ প্রকাশের কিছুদিন পর আত্মসমর্পণ করেন সজীব চৌধুরী ওরফে পাপ্পু। অস্ত্র, মাদক, ডাকাতিসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সজীবের অবর্তমানে পুরো গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাজীব।
স্থানীয়রা জানান, রাজীব ও সজীবের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। টঙ্গীর ভূঁইয়াপাড়ায় বেড়ে উঠেছেন তাঁরা। লেখাপড়ার জন্য ২০০৮ সালের দিকে লন্ডনে যান দুই ভাই। দুই থেকে তিন বছরের মাথায় দেশে ফিরে তাঁরা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। টঙ্গীর মধুমিতা, ভূঁইয়াপাড়া, নদীবন্দর, বউবাজার, জামাইবাজারসহ আশপাশের এলাকায় বিচরণ রয়েছে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, লোকজনকে মারধর, মাদক কেনাবেচাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার ভূঁইয়াপাড়ার একটি ফুচকা দোকানে তুষার আহম্মেদ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে মারধর করেন তাঁরা। খবর পেয়ে তুষারের ছোট ভাই তুহিনসহ আরও কয়েকজন এগিয়ে গেলে তাঁদেরও মারধর করা হয়। এরপর থানায় অভিযোগ দিতে গেলে হামলা চালানো হয় তুহিনদের বাড়ি ও দোকানে।
ডি কোম্পানির ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে রোববার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে হাজির করা হয়
ডি কোম্পানির ১২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে রোববার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে হাজির করা হয়ছবি: সংগৃহীত
ওই ঘটনা সম্পর্কে গতকাল র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই অপরাধী চক্রের কয়েকজন সদস্য ওই দিন টঙ্গীর আরিচপুর এলাকায় একটি ফুচকার দোকানে খেতে আসেন। সে সময় দোকানের সব চেয়ারে মানুষ বসা ছিল। তখন তাঁরা চেয়ার ছেড়ে দিতে বলেন। চেয়ার না ছাড়ায় অতর্কিত দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তুষার ও তাঁর ভাই তুহিনকে গুরুতর জখম করেন। এ ঘটনায় তুহিন টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি মামলা করেন। এরপর এই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যরা আরিচপুর এলাকার একটি দরজি দোকানে হামলা চালিয়ে তিনজনকে কুপিয়ে জখম করেন।
এই চক্রের গ্রেপ্তার অপর সদস্যরা হলেন মইন আহমেদ নীরব ওরফে ডন নীরব (২৪), তানভীর হোসেন ওরফে ব্যাটারি তানভীর (২৪), পারভেজ ওরফে ছোট পারভেজ (১৯), তুহিন ওরফে তারকাঁটা তুহিন (২১), রাজীব আহমেদ নীরব (৩০), সাইফুল ইসলাম ওরফে শাওন (২৩), রবিউল হাসান (২০), শাকিল ওরফে বাঘা শাকিল (২৮), ইয়াছিন আরাফাত ওরফে বিস্কুট ইয়াছিন (১৮), মাহফুজুর রহমান ফাহিম (২২) ও ইয়াছিন মিয়া (১৯)।
তাঁদের বয়স ১৯ থেকে ৩৫ বছর হলেও কিশোর গ্যাং বলা হচ্ছে কেন, এ প্রশ্নের জবাবে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, তাঁদের অধিকাংশ পাঁচ-সাত বছর আগে কিশোর বয়স থেকেই এই গ্রুপে যুক্ত হয়ে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। সে কারণে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে পরিচিত পান তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রাজীব ও সজীব দুজনেই স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে মিছিল-সমাবেশে দেখা গেছে। সজীবকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান সরকারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে এর আগে মশিউর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সজীব একসময় ছাত্রলীগ করতেন। পরে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।
স্থানীয় সূত্রমতে, প্রতিটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। এর মধ্যে গাজীপুর মহানগর পুলিশকে কিশোর গ্যাং নির্মূলে বেশ কিছুদিন তৎপরতা চালাতে দেখা যায়। এলাকায় এলাকায় সভা, সমাবেশ ছাড়াও সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোসহ নানা উদ্যোগ নেয় তারা। তবে এসব কিশোর অপরাধীদের প্রশ্রয়দাতাদের কাউকে আইনের আওতায় আনতে দেখা যায়নি।