জাওয়াদ তাহের
জীবন চলার পথে নানা রকম দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি আসে। সহ্য করতে হয় অসম্ভম যাতনা। এটাই দুনিয়ার অমোঘ সত্য বিধান। আর এর প্রভাব প্রাত্যহিক জীবনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা, অসহায়ত্ববোধের কারণে মূল্যহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েই চলছে। কিন্তু পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরগুলো শান্তি পায়।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)
আল্লাহর জিকির কিভাবে মানুষের অন্তরের প্রশান্তি দান করে, সেটা নিয়ে আমরা আলোকপাত করব, ইনশাআল্লাহ।
এক. মানুষের দুশ্চিন্তার অন্যতম একটি কারণ ভবিষ্যৎ-ভাবনা। আগামীকাল আমি কী খাব, কী পরিধান করব। এই বিষয়গুলো তার মাথায় গিজগিজ করতে থাকে, তাই তাঁর সব কিছু ঠিক থাকার পরও কেমন যেন এক অশান্তির রাজ্যে বাস করে। এর থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহ তাআলা আমার জন্য ভবিষ্যতে ভালোই রেখেছেন। কেননা যখন আপনি আল্লাহর জিকির করবেন তখন আপনি ভাববেন, আপনি আপনার জীবনে একা নন, আপনার সঙ্গে পরাক্রমশালী প্রভু আছেন; যিনি অদৃশ্য থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, আমার রব যার প্রতি ইচ্ছা তার রিজিক বাড়িয়ে দেন অথবা সীমিত করেন; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা জানে না। (সুরা সাবা, আয়াত : ৩৬)
দুই. দুশ্চিন্তার আরেকটি কারণ অতীত-ভাবনা। যা অতীতে চলে গেছে, তা ভেবে মানুষ দুশ্চিন্তায় কুঁড়ে কুঁড়ে মরতে থাকে। অতীতের বিভিন্ন অপরাধের কথা স্মরণ হলে নিজেকে লজ্জিত মনে হয়। কিন্তু আল্লাহর জিকির এই দুশ্চিন্তা থেকে পরিত্রাণ দেবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা জুমার, আয়াত : ৫৩)
তিন. মানুষ অনেক সময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয় তার শক্তি-সামর্থ্যের কারণে। তার লোকবল ও শক্তি-সামর্থ্য নেই; তাই সে একটু ভীতসন্ত্রস্ত ও চিন্তিত থাকে। তাকে কেউ আক্রমণ করবে তার ওপর অত্যাচার করবে, এসব ভেবে স্বস্তি ও স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃত বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করবে, তার সক্ষমতা ও দেওয়ার কথা চিন্তা করবে; তিনি আমার জন্য যথেষ্ট, দুনিয়ার কোনো শক্তি সামর্থ্য ও লোকবল যদি না-ও থাকে, একমাত্র আল্লাহ তাআলা আমাকে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট। এ কথাগুলো যখন সে চিন্তা করবে তার দিনটি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিমুক্ত হয়ে যাবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) বলেন, আর জেনে রাখো, যদি সব উম্মত (জাতি ও দল) তোমার কোনো উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু উপকার করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অন্যদিকে যদি সব উম্মত তোমার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু ক্ষতি করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ তাআলা তোমার তকদিরে লিখে রেখেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬ )
চার. মানুষ কখনো কখনো অনেক কষ্ট-সাধনা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু তার এই কষ্ট-শ্রমের কেউ-ই মূল্যায়ন ও কৃতজ্ঞতা আদায় করতে রাজি নয়। এই অবস্থা মানুষকে অনেক সময় ভাবিয়ে তোলে, চিন্তিত করে তোলে। কিন্তু বান্দা যখন এ কথা জানবে যে তার এই চেষ্টা-সাধনা একজন জানে। তিনি তার যথাযথ প্রতিদান দেবেন, তখন সে আর চিন্তিত আর পেরেশান হবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘বলে দাও, হে আমার মুমিন বান্দারা, তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করো। যারা এ দুনিয়ায় কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণ। আর আল্লাহর জমিন প্রশস্ত, ধৈর্যশীলদের তাদের পুরস্কার পরিপূর্ণরূপে দেওয়া হবে অগণিত পরিমাণ।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ১০ )
পাঁচ. মন্দ ধারণা কখনো কখনো মানুষকে চিন্তিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার পেরেশানি বাড়িয়ে তোলে। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর দয়া ও মানুষের প্রতি ভালো ধারণা ধীরে ধীরে তার এই কষ্ট লাঘব করে। তার অন্তর লাভ করে অদৃশ্য এক প্রশান্তি। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল (সা.)-কে তাঁর মৃত্যুর তিন দিন আগে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ না করে মৃত্যুবরণ না করে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩১১৩)
ছয়. দুনিয়ার প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। অনেক সময় এমন হয়, নির্ধারিত কোনো বিষয় না পেলে; বাসস্থান, পোশাক বা অন্য কিছু না পেয়ে বিষণ্নতা ও অবসাদে ভুগতে থাকে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান, দুনিয়াবিমুখতা ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-যাপন তাকে এ ধরনের কষ্ট থেকে সর্বদা দূরে রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা এ জন্য যে তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার জন্য আনন্দিত না হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো উদ্ধত-অহংকারীদের।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত : ২৩)
সাত. মৃত্যুচিন্তা মানুষকে প্রতিনিয়ত চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। মৃত্যু যখন শুধুই বার্ধক্য বয়সে হয় এমনটা নয়; বরং সব বয়সী মানুষের এই মৃত্যু হয়। তাই একটু অসুস্থ হলে ভাবতে থাকে যদি মৃত্যু এসে যায়, তাহলে জীবনের সব আশা মাটি হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা বস্তুবাদী তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা প্রকট। কিন্তু একজন প্রকৃত ঈমানদার তার বিশ্বাস এবং তার আস্থা, মৃত্যুই সব কিছুর শেষ নয়; বরং মৃত্যু এক অসীম জগতের দুয়ার। এ জীবন থেকে আরো শ্রেষ্ঠ জীবন হবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে তাদের জন্য আছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা বুরুজ, আয়াত : ১১)