ফারুক মেহেদীঅর্থনীতির ক্ষতি পোষাতে কী করা উচিত? টাস্কফোর্স গঠন করা যায় কি না? অর্থায়ন হবে কীভাবে? এসব বিষয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দীন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক মেহেদী।
আজকের পত্রিকা: করোনাকালীন অর্থনীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: এর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। করোনায় যে ক্ষতি হলো, তার কোনো হিসাব নেই আমাদের। আমরা যদি ক্ষতির হিসাবটা বের করতে পারি, এরপর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা যাবে। যেমন ধরুন, পোশাক খাত, অবকাঠামো খাত, ওষুধ খাত, ব্যাংকিং খাত–সব খাতেই তো ক্ষতির রেশ আছে। এই পুরো ক্ষতির হিসাবটা আমাদের করতে হবে। এটা সরকারের প্রধান কাজ।
আজকের পত্রিকা: সরকার কীভাবে করবে এ কাজটা? এ সক্ষমতা কি আছে?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: এটা বিবিএসকে দিয়ে নয়, এ কাজ করতে হবে প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে। তারা দেশি বা বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে এটা পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। সরকারের নিজের কোনো সক্ষমতা নেই এ কাজে। এটা স্বীকার করতে হবে যে, গতানুগতিক আমলাতন্ত্র দিয়ে এটা হবে না। এ জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। টাস্কফোর্স প্রতিবেদন দেবে, কোন খাতে কী কী ক্ষতি হলো।
আজকের পত্রিকা: এর পর কাজটা এগোবে কীভাবে?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: এটাই হলো পরবর্তী কাজ। সে জন্য কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিটি খাতের জন্য কর্মপরিকল্পনা। এরপর সুপারিশমালা তৈরি করতে হবে, কার জন্য কী করতে হবে। সরকারকে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করলে হবে না। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া খেয়াল-খুশিমতো সিদ্ধান্ত দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম নেওয়া যাবে না। সরকারের নিজস্ব একটা সুদূরপ্রসারী টেকসই পরিকল্পনা থাকতে হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকার কাজ করবে। এরপর কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কারিগরি নির্দেশনা তৈরি করতে হবে।
আজকের পত্রিকা: অর্থায়নটা হবে কীভাবে?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: এডহক বেসিসে সিদ্ধান্ত নিলে কোনো কিছুই ঠিকমতো হয় না। তো সবকিছু যখন পরিকল্পনামতো হবে, তখন আপনি ব্যাংক থেকে কত টাকা নিতে পারবেন, বন্ড মার্কেট থেকে কত নিতে পারবেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অনেক রিসোর্স আছে, তারা কি করতে পারে–এটাও দেখতে পারেন। ঋণের ক্ষেত্রেও একটা সুষ্ঠু নীতিমালা করতে হবে। সব মিলিয়ে পুরো ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির জন্য তিন থেকে চার লাখ কোটি টাকার একটা প্যাকেজ বানাতে হবে। মোটকথা, পুঁজিবাজার, বন্ডবাজার আর সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ থেকে এ তহবিল নিতে হবে।
আজকের পত্রিকা: টাস্কফোর্সটা কীভাবে কাজ করবে?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: প্রকৃত পেশাজীবীদের রেখে এই টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এরাই সুপারিশ করবে কী করতে হবে। এখন চীন এবং আমেরিকার যে বাণিজ্যযুদ্ধ; এটা থেকে বাংলাদেশকে সুবিধা নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যে টাস্কফোর্স থাকবে তারা এ কাজ করবে। চীন থেকে সরাসরি আমেরিকা পণ্য নেবে না। ভেতরে-ভেতরে অর্থনৈতিক কূটনীতি কাজে লাগিয়ে চীনের কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করিয়ে, মেড ইন বাংলাদেশ নামে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে আমেরিকায় রপ্তানির সুযোগ নিতে হবে। এখানে বাংলাদেশি কোম্পানি হবে স্থানীয় মালিকের নামে আর বিনিয়োগ থাকবে চীনের। এভাবে সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
আজকের পত্রিকা: প্রণোদনার টাকা বরাদ্দ ও ঋণ নিয়েও তো প্রশ্ন আছে।
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: প্রণোদনার টাকার অপচয় ও অপব্যবহার হচ্ছে এটা ঠিক। এর কারণ হলো আমাদের যে ব্যাংকিং সিস্টেম, সেখানে অনেক দুর্বলতা আছে। এগুলো তো ঠিক করা হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক চলছে রাজনৈতিক দলের লোকজন দিয়ে। এখানে দরকার সত্যিকার অর্থে পেশাগতভাবে দক্ষ লোকজন। আমাদের ব্যাংকিং খাতে ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না। এখানে পেশাগত সুশাসন নেই। সরকারি ব্যাংক গতানুগতিক, আর বেসরকারি ব্যাংক অতি স্মার্ট। কিন্তু উভয়ই ঘুষ খায়। আসলে ওপরে ঠিক থাকতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলাদা ব্যাংকিং বিভাগ দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করেন।
আজকের পত্রিকা: রাজস্ব খাতও কি ঠিকমতো দক্ষতা দেখাতে পারছে?
ড. জামালউদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় পদ্ধতিও গতানুগতিক। দেশে অন্তত ১০ থেকে ১৫ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা আছে। এদিকে কোনো নজর নেই। এনবিআরের কাঠামোটাই ঠিক নেই। এখানে নিজেরাই যদি সমস্যার অংশ হয়, তাহলে সমাধান হবে কী করে? এটা পলিসি ডিপার্টমেন্ট, একে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে। এনবিআরকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বাধীন বিভাগ করতে হবে। না হলে এর কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলবে না।