হায়দার আলী ও সাজ্জাদ হোসেন
‘এই চুপ চুপ!, সবাই চুপ করেন, আপা ফোন দিয়েছেন।’ সামনে বসে থাকা লোকজনকে হঠাৎ এভাবেই ভড়কে দেন মো. আবুল হোসেন ওরফে মানিক। ফোন রাখার ভান করে বলেন, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ফোন করেছেন এবং মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তাঁর পক্ষে এই অনুরোধ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। উপস্থিত লোকজনকে বিশ্বাস করাতে তিনি এমনও বলেন, প্রতি সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ফোন করে খোঁজখবর নেন। শিগগিরই তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন!
প্রতারণার উদ্দেশ্যে এজাতীয় আজগুবি মিথ্যা কথা বলে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করেন মানিক, যাঁর বয়স কিনা ৮০ পেরিয়ে গেছে! ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ’ নামে পকেট সংগঠন গড়ে নিজেকে এর ‘প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি’ পরিচয় দেন। রাজধানীর ফকিরাপুলের মতো ব্যস্ততম জায়গায় কার্যালয়। এরই মধ্যে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহীসহ সারা দেশে শতাধিক শাখা কমিটি করে দিয়েছেন। আর কমিটিতে পদ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, কখনো বা সরকারি চাকরি ও মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন আনুমানিক কয়েক কোটি টাকা। এসব অপকর্মে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের জাল স্বাক্ষরসংবলিত একটি চিঠি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মানিকের কাছে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। রেহাই পাননি ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাবেক নেতারাও।
রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার (আগের রাজপাড়া থানা) হরোগ্রাম পূর্বপাড়ার মৃত শেখ তালেব আলীর ছেলে এই আবুল হোসেন মানিক। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যানুযায়ী জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ মে। বয়স ৮২ বছর প্রায়। তবে অন্যের সহানূভূতি আদায়ে বলে বেড়ান তাঁর বয়স ৯৪ ছাড়িয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ না করেও নিজেকে পরিচয় দেন মুক্তিযোদ্ধা। কর্মজীবনে ছিলেন পোস্টমাস্টার, কিন্তু পরিচয় দেন তিনি অবসরপ্রাপ্ত সচিব। এসব অপকর্মের সার্বক্ষণিক সহচর মো. আব্দুল লতিফ নামের এক ব্যক্তি। লতিফ ‘আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ’ নামের কথিত একটি সংগঠনের ‘অফিস সহায়ক’ ছিলেন। মানিক তাঁকে নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগে’ দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে বানানো একটি চিঠি আসে কালের কণ্ঠ’র হাতে। এই চিঠির সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামলে মানিকের প্রতারণার অনেক তথ্য উঠে আসে। গত ৪ জুলাই ১৮৮ ফকিরাপুলের অষ্টম তলায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাজির হয় কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দল। চার কক্ষের ফ্ল্যাটটি কার্যালয়ের পাশাপাশি নিজেদের আবাসস্থল হিসেবেও ব্যবহার করেন মানিক-লতিফ।
পরিচয় আড়াল করে কথিত এই সংগঠনের সদস্য হতে চাইলেন কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দলের সদস্যরা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের গুরুত্ব বোঝাতে প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর জাল স্বাক্ষর করা চিটিঠি দেখান। মানিক ও লতিফ দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের এই সংগঠন গড়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে খুব শিগগির মন্ত্রিত্বও গ্রহণ করবেন মানিক। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে নিয়েও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন তাঁরা। এরপর তাঁরা সংগঠনের গঠনতন্ত্র দেখিয়ে ফরম কেনার আহ্বান জানান। গোপনে ধারণ করা এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ কালের কণ্ঠ’র হাতে রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দপ্তরে যায় কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দল। এ সময় মন্ত্রীর কক্ষে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান। মানিকের প্রতারণার কিছু নজির তুলে ধরলে থ হয়ে যান বর্ষীয়ান দুই রাজনীতিবিদ। মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমি কখনোই কাউকে এমন চিঠি দিইনি। চিঠিতে আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এ ছাড়া এই ধরনের সংগঠন অনুমোদনের এখতিয়ার আমার নেই। আমি কিভাবে এর অনুমোদন দেব? আর আমি প্রধানমন্ত্রীর হাতের লেখা খুব ভালো করে চিনি। লতিফের চিঠির সুপারিশটি প্রধানমন্ত্রীর হাতের লেখা নয়। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরটিও স্ক্যান করে চিঠিতে বসানো হয়েছে।’ পরে মন্ত্রী একজনকে দায়িত্ব দেন মানিক আসলেই মুক্তিযোদ্ধা কি না খোঁজ নিয়ে দেখার জন্য। দীর্ঘক্ষণ পর তিনি এসে জানান, মানিকের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ভুয়া। মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকাতেই মানিকের নাম নেই।
ভুক্তভোগীদের কথা : কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী দল মানিকের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেলের বাড়িতেও যায়। জানা যায়, মানিক ও লতিফের কাছে প্রতারিত হয়ে ৩০ লাখ টাকার বেশি খুইয়েছেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ও সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। সংগঠনের নাম শুনে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। সোহেল বলেন, ‘মানিক আমাকে বলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে তাঁকে এই সংগঠন তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। পরে মানিক আমাকে ফরম সংগ্রহ করে সংগঠনের সদস্য হতে বলেন। সদস্য হওয়ার পর তিনি আমাকে সাধারণ সম্পাদক করেন। এরপর অফিস ভাড়া, সংগঠনের বিলবোর্ড-পোস্টার ছাপানো ও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আমার কাছ থেকে ধাপে ধাপে অনেক টাকা নিয়েছেন। এক পর্যায়ে ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেন মানিক। এ জন্য সমাবেশের কয়েক দিন আগেই পোস্টার ছাপানো ও সারা দেশ থেকে আগত কর্মীদের জন্য খাবার সরবরাহের দায়িত্ব দেন আমাকে। সেই অনুযায়ী সব কাজ শেষও করি।’
সোহেল আরো বলেন, ‘মঞ্চ তৈরি, মাইক ও ডেকোরেশনের কাজের জন্য আমার কাছ থেকে মানিক নেন ১৩ লাখ টাকা। সমাবেশের আগের দিন প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গেলে আমরা মানিকের প্রতারণার বিষয়টি ধরতে পারি। তবে এর আগেই সমাবেশ আয়োজন উপলক্ষে আমার ২০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার আবেগ নিয়ে প্রতারণা করেছেন মানিক। সব খুইয়ে আমি জানতে পারি মানিক আসলে মুক্তিযোদ্ধাই নন। মুক্তিযোদ্ধা লীগও কোনো নিবন্ধিত সংগঠন না।’
মানিকের কাছে প্রতারণার শিকার আরেকজন গাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ হাওলাদার। তাঁকে করা হয়েছিল জেলা কমিটির সভাপতি। ইউসুফ হাওলাদার বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, সেই আবেগ থেকে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগে যোগ দিয়েছিলাম। কিছুদিন পরই জানতে পারি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানিক নিজেই মুক্তিযোদ্ধা নন। এই ঘটনার প্রতিবাদ করলে আমার সঙ্গে প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার করেন মানিক। আমি তাঁর অফিস থেকে বের হয়ে আসি, আর কখনো যাইনি।’
প্রতারণার শিকার লিয়াকত হোসেন, যাকে দেওয়া হয়েছিল এই সংগঠনের সহসভাপতির পদ। লিয়াকত বলেন, ‘মানিকের কথিত সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক লতিফও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেন। মূলত এই দুজন মিলেই খুলে বসেন প্রতারণার কারখানা। ভুয়া সংগঠনে পদ দেওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকেও তাঁরা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। পরে আমি সংগঠন ছেড়ে চলে আসি।’
মানিকের প্রতারণার আরেক শিকার খুলনার বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী হারুন অর রশিদ। কথিত সংগঠনের খুলনা বিভাগীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ধরতে পারেন মানিকের প্রতারণা। কমিটিতে যুক্ত হতে না হতেই বিনা সুদে ১৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ২০ লাখ টাকা। ঋণ হয়ে গেছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নকল স্বাক্ষরসংবলিত একটি ভুয়া ব্যাংক ঋণের কাগজও বুঝিয়ে দেন মানিক। যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে গেলে জানা যায় এ ধরনের কোনো কাগজ বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যুই করেনি এবং স্বাক্ষরটিও ছিল ভুয়া।
মানিকের প্রতারণার বিষয়ে লেখক ও নাট্যকার যাযাবর স্বপন বলেন, ‘২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি মুক্তিযোদ্ধা লীগের সদস্য এবং কিছুদিন পর গবেষণা সম্পাদক হই। এক পর্যায়ে বুঝতে পারি মানিক প্রতারণা করছেন। প্রতিনিয়ত তিনি কমিটি থেকে কিছু নেতাকে বাদ দেন আর টাকার বিনিময়ে নতুন নিয়োগ দেন। তাই আমি সংগঠন থেকে সরে আসি।’ মানিক-লতিফকে তিনি গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
মানিক-লতিফের এসব অপকর্ম ও প্রতারণার বিশদ বিবরণ জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সাহিদ হোসেন স্মরণ। তিনি আরো জানান, মানিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। একই তথ্য দেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের রাজশাহী জেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম এম ইয়াছিন আলী মোল্লা। মানিকের প্রতিবেশী ও পশু চিকিৎসক সেলিনা বেগম জানান, মানিকের জীবটাই প্রতারণায় মোড়া। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক মানিককে স্থানীয়রা ‘চিটার মানিক’ হিসেবেই চেনেন। একসময় রাজশাহী জিপিও-৬০০-এ পোস্টমাস্টার হিসেবে চাকরি করতেন মানিক। দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারিয়ে কিছুদিন বীমা কম্পানিতেও চাকরি করেছেন। সেই সময় প্রতারণা করে মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করেন তিনি। একই সঙ্গে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ নামের একটি সংগঠনের বিভাগীয় নেতা হিসেবে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই পাওনাদারদের চাপে ঢাকায় চলে আসেন মানিক। গঠন করেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ।
মানিকের বক্তব্য : অভিযোগের বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে আবুল হোসেন মানিক কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলকে বলেন, ‘আমি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কার্ড করা হয়নি। এমনকি সরকারের কোনো ভাতাও নিই না, কারণ আমার প্রয়োজন হয় না। সংগঠনটি শুরু করার পর আমার একটি প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে। আমি কারো সঙ্গে প্রতারণা করিনি, কেউ এমন প্রমাণ দিতে পারবে না।’ প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল এবং ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই আপনি আমার সঙ্গে একটু দেখা করেন। মোবাইলে সব কিছু বলা যায় না। সামনাসামনি সব বুঝিয়ে বলা সম্ভব।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত চিঠি কোনো সময়ই এমন হবে না। সেখানে স্বারক নম্বর দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ফর্মালিটি থাকবে। আর প্রধানমন্ত্রী কখনোই এই ধরনের চিঠিতে স্বাক্ষর করেন না। আবুল হোসেন মানিক প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীর স্বাক্ষর জালের পাশাপাশি ভুঁইফোড় সংগঠন খুলে অনেক বড় প্রতারণা করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’