অবশেষে জিম্মি ঘটনার অবসান ঘটল। পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেন গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। তাদেরও চাওয়া পূরণ করল সরকার। বৃদ্ধি করা হলো বাসের ভাড়া। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার সকাল থেকে রাজধানীতে চলছে গণপরিবহণ। রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্য ছেড়েও যাচ্ছে দূরপালস্নার বাসগুলো।
সোমবার রাজধানীর চারটি মোড় ঘুরে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি সিটিং সার্ভিস ও লোকাল বাসের রুট ভিন্নতায় ৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। যা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি বলে মনে করেন যাত্রীরা। তাদের অভিযোগ, ভাড়া যা নির্ধারিত হয়েছে তার থেকে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে।
ফার্মগেট দিয়ে মিরপুর-আশুলিয়া-সাভারের বাসগুলো গুলিস্তান, সদরঘাট, সায়দাবাদ, সাইনবোর্ড যায় এমন অন্তত ১০টি বাসের হেলপার, ড্রাইভার ও চেকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নূ্যনতম ১৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
মগবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে সায়দাবাদ, গুলিস্তান, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুর, শ্রীপুর, বরমী লাইনে চলাচল করে এমন চারটি সিটিং সার্ভিস ও লোকাল বাসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও নূ্যনতম
৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। কয়েকদিন আগেও বাসে উঠলেই ১০ টাকা দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা।
নিউ ভিশন, শিকড়, লাভলী, ল্যামস, বিকল্প, দেওয়ান, তানজিল, খাজা বাবা জাস্ট পরিবহণ হলুদ ও নীল এ ছাড়া ৩ নম্বর পরিবহণসহ লোকাল বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে নূ্যনতম ৫ থেকে ৩০ টাকা। লাভলী বাস সাভার থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত চলাচল করে। আগে নিত ৭৫ টাকা এখন নিচ্ছে ৯৫ টাকা।
এদিকে, সায়দাবাদ বা গুলিস্তান থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী পর্যন্ত চলচল করা বলাকা পরিবহণ আগে ভাড়া নিত ৬০ টাকা এখন ভাড়া নিচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। সাইনবোর্ড থেকে শ্রীপুর চলাচল করে বনশ্রী পরিবহণ। তারা ভাড়া নিচ্ছে ১০৫ টাকা। আগে ভাড়া ছিল ৮৫ টাকা। আজমেরী গেস্নারী সদরঘাট থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চলাচল করে। তারা আগে ভাড়া নিত ৯০ টাকায়। এখন ভাড়া নিচ্ছে ১১০ টাকা।
সব ক্ষেত্রেই গলা কাটা হচ্ছে যাত্রীদের এমনটাই মন্তব্য। বাসযাত্রী ব্যবসায়ী স্বপন ব্যাপারী বলেন, এই দেশে সবাই জনগণকেই জিম্মি করে। আর নিজেদের আখের গোছায়। বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হেলপার বলে দিল নূ্যনতম ভাড়া ১৫ টাকা। ঢাকায় এখন আর সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারবে না। হেঁটেই পথ পারি দিতে হবে।
হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজপড়ুয়া নাসরিন বলেন, ফার্মগেট থেকে খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ি ভাড়া ছিল ১০ টাকা এখন ১৫ টাকা। তার ওপর এসব বাসে হাফপাস নাই। আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের ওপর জুলুম হচ্ছে। আমরা জিম্মি। আমাদের খরচ দিতে বাবা-মায়ের হিমশিম খেতে হবে।
বেশ কয়েকজন যাত্রী বলেন, ভাড়া বৃদ্ধি এক দিনের জন্য হয়নি। হিসাব করে দেখেন এই ভাড়া ৩৬৫ দিনের জন্য। তাহলে আমাদের চলাফেরায় কত টাকা বেশি লাগবে? এতটা কি আয় সাধারণের বৃদ্ধি পেয়েছে? বাস মালিকরা চাইল আর সরকার বৃদ্ধি করে দিল! সাধারণের সঙ্গে কী এবারও কথা বলেছেন সরকারের কেউ?
বাস কোম্পানিগুলোর চেকার ও সুপারভাইজাররা বলেন, বাসের খরচ আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যে চাকা ১৫ হাজারে পাওয়া যেত সে চাকা এখন কিনতে হচ্ছে ৪৫ হাজারে। সিএনজিতে চালালে বাসের ইঞ্জিন সিস করে। তাই ডিজেলে চালাতে হচ্ছে। সবদিকেই খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এবার ভাড়াও সমন্বয় করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগে দূরপালস্নার বাসের ভাড়া নির্ধারিত ছিল কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা আর বর্তমানে ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে ১ টাকা ৮০ পয়সা। মহানগরীতে বিভিন্ন রুটের ভাড়া ছিল কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। মিনিবাসের আগে ভাড়া ছিল কিলোমিটার প্রতি ১ টাকা ৬০ পয়সা বর্তমানে ২ টাকা ৫ পয়সা। কিন্তু হিসাব করে দেখা যায়, রাজধানীর ভিতরে একটি বাস কোম্পানিও সরকার নির্ধারিত ভাড়া নিচ্ছে না।
এদিকে পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে রোববার রাত থেকেই বিভিন্ন গন্তব্যে রাজধানী ছেড়েছে দূরপালস্নারা বিভিন্ন রুটের বাস। টানা তিন দিনের ধর্মঘটের কারণে সোমবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর বাসস্ট্যান্ড ও দূরপালস্নার বাসের বিভিন্ন কাউন্টারে যাত্রীদের ব্যাপক চাপ দেখা গেছে। অনেকেই দেখা গেছে রোববার রাত থেকেই টিকিটের জন্য এসব কাউন্টারে সামনে এসে অপেক্ষা করেন।
এদিন রাজধানীর গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনালসহ, আসাদগেট, কল্যাণপুর ও শ্যামলীসহ পরিবহণের কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রায় বেশিরভাগ বাসই নতুন নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করছে। এসব বাসের যাত্রীরা জানান, সরকার নির্ধারিত দামে তারা টিকিট সংগ্রহ করেছেন। তবে কাউন্টারগুলোয় নতুন ভাড়ার চার্ট না থাকায় সমালোচনা করেছেন।
তার স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন বাসে অনেকেই আগের ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করছে। মূলত এসব রুটের অনেকেই কাউন্টার থেকে টিকিট না সংগ্রহ করায় এবং ভাড়ার তালিকা হাতে না থাকায় আগের ভাড়াই নিয়েছেন।
বাড়তি যাত্রীর চাপ সামলাতে সোমবার সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের সংখ্যা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন হানিফ ও শ্যামলী কর্মকর্তরা। এ ছাড়া তারা চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়াসহ বেশকিছু রুটে নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় ২০ থেকে ৩০ টাকা কম নিচ্ছেন। শ্যামলী পরিবহণের কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে সিলেটের ভাড়া ১০০ টাকার ওপর বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও এদিন ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। একইভাবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কুষ্টিয়া জণ্য নির্ধারিত ভাড়ার থেকে যথাক্রমে ৫০ ও ৩০ টাকা কম নেওয়া হয়।
এ ছাড়া রাজধানী বেশ কয়েকটি কোম্পানির এসি বাসে আগের ভাড়াতেই যাত্রীপরিবহণ করতে দেখে গেছে। তবে পরে নতুন ভাড়া কার্যকর হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
হঠাৎ ঘোষিত ধর্মঘটে রাজধানীতে এসে আটকে পড়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সাধারণ যাত্রীারা। যাত্রীরা বলেন, অনেইে চিকিৎসা, চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষা এবং ব্যবসাসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজেনে এসে আটকা পড়েন। আবার অনেকেই ধর্মঘটের কারণে কোথাও যেতে পারেনি। বরাবরাই জ্বালানি তেল হোক বা চাল ডাল হোক, বাড়তি মূল্যে জনগণকেই দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের মুনাফার কোনো ঘাটতি হয় না বরং আরও বাড়ে। তবু আমাদের ভোগান্তি কমে না বলে মন্তব্য করেন যাত্রীরা।