গ্রুপ পর্বে যে দলটি সউদী আরবের সঙ্গে ২-১ গোলে হেরে আসর শুরু করেছিল, এর পর থেকে যাদের প্রতিটি ম্যাচই খেলতে হয়েছে নক আউট ভেবে, ২১ দিনের ব্যবধানে সেই দলটিই কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে! নামটি আর্জেন্টিনা বলেই হয়তো খুব একটা অবাক হওয়ার নয়। আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে এই দলে একজন লিওনেল মেসিও যে আছে!
হ্যাঁ। ঠিক তাই। আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন এটা তার শেষ বিশ্বকাপ। আর শেষ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে ফিরে যাওয়ার যে কোনো ইচ্ছে নেই সেটা মেসি আগেও বুঝিয়েছেন, বুঝালেন এদিনও। কাতারের দোহার লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে পেনাল্টি থেকে নিজে গোল করলেন মেসি, হুলিয়ান আলভারেজকে দিয়ে করালেন আরও একটি। কম যাননি আলভারেজও। মেসির পাস থেকে দ্বিতীয় গোলটা করার আগে প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনিও অবিশ্বাস্য একটা গোল করেছেন। আলভারেজের দুই ও মেসির এক গোল মিলিয়ে আর্জেন্টিনা ম্যাচটা জিতেছে ৩-০ গোলে। ২০১৪ সালের পর আরও একবার উঠে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। অন্যদিকে গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়ার পথচলা এবার থেমে গেছে শেষ চারেই, শেষ হয়ে গেছে বিশ্বকাপে আরেক এলএম-১০ লুকা মদ্রিচের অধ্যায়ও।
এদিন লুসাইলে প্রথম আধঘন্টা আসলে ক্রোয়েশিয়াই খেলেছে। খেলেছে বলতে প্রথম স্পর্শেই দারুণ সব পাস দিয়েছে, আবার বলের দখলও রেখেছে। কিন্তু অ্যাটাকিং থার্ডে যেতে পারছিল না খুব একটা। সেই সময়টা আর্জেন্টিনা বরং ক্রোয়েশিয়ার খেলা নষ্ট করতেই বেশি ব্যস্ত থেকেছে। নিজেরা খুব একটা গুছিয়ে উঠতে পারছিল না। ১৬ মিনিটে একটা কর্নার পায় ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু বিপদ হতে দেননি আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডাররা।
২৪ মিনিটে এনজো ফার্নান্দেজ একটা শট নিয়েছিলেন বক্সের বাইরে থেকে। কিন্তু সেটা ঠেকাতে কষ্ট হয়নি ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকোভিচের। দুই মিনিট পরে মেসির কাছ থেকে দারুণভাবে বল কেড়ে নিয়ে পাস বাড়ান মাতেও কোভাচিচ। বল ছুটতে থাকা ক্রামারিচকে আটকাতে গিয়ে তাঁকে ফাউল করে ফ্রি-কিক দেন তালিয়াফিগো। তবে মদ্রিচের সাদামাটা ফ্রি-কিক কাজে লাগাতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। ৩১ মিনিটে নাহুয়েল মলিনার চোখ এড়িয়ে বাঁ দিক থেকে আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুলে পড়েন ইভান পেরিসিচ। তবে তার শট রদ্রিগো দি পলের গায়ে লেগে চলে যায় মাঠের বাইরে। তবে সেটা রেফারির চোখ এড়িয়ে যাওয়ায় কর্নার পায়নি ক্রোয়েশিয়া।
ম্যাচটা জমে উঠে এর পরপরই। রক্ষণভাগে ওতামেন্দির কাছ থেকে বল পেয়ে এনজো ফার্নান্দেজ লম্বা পাস বাড়িয়েছিলেন হুলিয়ান আলভারেজকে। ক্রোয়াট রক্ষণ ছিটকে দিয়ে ছুটে যাওয়া আলভারেজকে ঠেকাতে সামনে এগিয়ে এসে শরীর দিয়ে বাধা দেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক লিভাকোভিচ। তাঁকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারি। স্পট কিক থেকে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন দলনেতা মেসি। এটা ম্যাচের ৩৪ মিনিটের কথা। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডে জার্মান কিংবদন্তি লোথার ম্যাথিউসকে (২৫) ছোঁয়ার দিনে গড়ে ফেললেন আরেক রেকর্ড; গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে ছাড়িয়ে বিশ্ব সেরার মঞ্চে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন মেসি, ১১টি। এবারের বিশ্বকাপে তার গোল হলো ৫টি, গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে আগে থেকে শীর্ষে থাকা কিলিয়ান এমবাপের পাশে বসলেন তিনি। ক্যারিয়ারে মেসির মোট গোল হলো ৯৬টি।
কিন্তু ম্যাচের সেরা মুহুর্ত আসলে তখনো আসেনি। হুলিয়ান আলভারেজ পেনাল্টি এনে দিয়েই দায়িত্ব শেষ মনে করেননি যে! মিনিট পাঁচেক পরে মাঝমাঠে ফাউলে পড়ে গিয়ে মেসি ফ্রি-কিকের আবেদন করছেন, বল আলভারেজের পায়ে দেখেই হয়তো রেফারি খেলা চালিয়ে গেলেন। ড্রিবল করে তিন ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়কে পেরিয়ে গেলে আলভারেজ। ও দিকে রদ্রিগো দি পল ও মলিনা ছুটে গিয়ে বিভ্রান্ত করে দিলেন ক্রোয়াট রক্ষণভাগকে। ডি-বক্সে ঢুকে আলভারেজ ক্রোয়াট ডিফেন্ডার বোরনা সোসাকেও কাটালেন, তারপর লিভাকোভিচকে কাটিয়ে বল পাঠালেন জালে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার মতো নয় হয়তো, তবে আলভারেজের গোলটা দেখে সবার আগে হয়তো দর্শকদের ওই গোলের কথাই মনে হয়েছে।
ম্যাচটা ওখানেই অর্ধেক শেষ হয়ে গিয়েছিল। জয়-পরাজয় নিয়ে অনিশ্চয়তা যতটুকু ছিল সেটা বিরতির পর মাঠে নেমে শেষ করে দিলেন আবার সেই মেসি-আলভারেজ জুটি। ৬৯ মিনিটের সেই গোল অবশ্য একেবারে নিখাদ মেসি-জাদু। অসাধারণ নৈপুন্যে ডান পাশ দিয়ে ক্রোয়াট রক্ষককে এলোমেলো করে দিয়ে বল নিয়ে ঢুকলেন, সঙ্গে পুরোটা সময় লেগে রইলেন ইয়োস্কো গাভারদিওল, অনেকের মতে যে আসরের সেরা ডিফেন্ডার। তাকে কাটাতে বল নিয়ে গেলেন একেবারে সীমানার কাছাকাছি। বক্সে ঢোকার মুখে মেসি থামলেন, করণীয় ঠিক করলেন, ঘুরলেন, এক ঝটকায় একটু এগিয়ে বাইলাইন থেকে বল বাড়ালেন ছয় গজ বক্সে। সেখান থেকে কাট ব্যাক করে আলভারেজকে পাস বাড়ালেন। এই গোল নষ্ট করার লোক আলভারেজ নন। অনায়াসে প্লেসিং শটে বাকি কাজটা সারলেন আলভারেজ। ২২ বছর বয়সী তরুন এই ফরোয়ার্ডের আগের গোলটা যদি টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা, মেসির এই অ্যাসিস্ট সম্ভবত আসরের সেরা অ্যাসিস্ট। এরপর আর ক্রোয়েশিয়া এই ম্যাচে ফিরতে পারে নাকি