গত বছরের শেষ দিকে রাজনীতির মাঠে ঢেউ তুলেছিল বিএনপি। ঢাকার সমাবেশের আগপর্যন্ত বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায়ই ছিল। বিভাগীয় সমাবেশগুলোয় গণ–উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।বিভিন্ন দলের যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা ও বিভাগীয় সমাবেশগুলোয় ব্যাপক জনসমাগমের পরও বিএনপির মধ্যে একটু ঝিমুনি লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি দারুণভাবে চাঙা হয়েছিল। চাঙা অবস্থা থেকে বিএনপি পিছু হটতে শুরু করে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। মূলত, পল্টনে সমাবেশ করতে না পারা বিএনপির জন্য একধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়। সরকারের চাপের মুখে বিএনপি বলতে শুরু করে, নিরাপদ ও সুবিধাজনক স্থানে তারা সমাবেশ করার কথা বিবেচনা করবে। বিএনপির নমনীয় অবস্থান বুঝতে পেরেই আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে চলে যায়। ৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় এক বিএনপি কর্মী নিহত হন। পুলিশ অভিযান চালায় বিএনপির অফিসে।এই ঘটনার পরপরই বিএনপিকে কিছুটা অগোছালো মনে হয়। দলীয় অফিসে হামলা এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতা–কর্মীদের গণহারে আটকের পর কোনো শক্তিশালী কর্মসূচি ঘোষণা করেনি বিএনপি। ৭ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা একা কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ফুটপাতে অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। এ সময় অন্য কোনো নেতা–কর্মীকে তাঁর পাশে দেখা যায়নি। অথচ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর ঢাউস আকারের কমিটি হয়। ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের কমে কোনো কমিটি হয় না। দলের সংকটময় মুহূর্তে এসব কমিটির সদস্যরা কোথায় ছিলেন, তা কেউ জানেন না।
১০ ডিসেম্বর পল্টন থেকে সমাবেশ সরিয়ে নিয়ে বিএনপি মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক খেলায় হেরে যায়। গোলাপবাগে বড় সমাবেশ হলেও এটা বিএনপির চেয়ে সরকারের সফলতা বেশি ছিল। সরকার বা আওয়ামী লীগ এই ঘটনায় প্রমাণ করতে পেরেছে যে তারা যেভাবে চেয়েছে, বিএনপি সেভাবেই সমাবেশ করেছে।
মূলত, ১০ ডিসেম্বেরকে ঘিরে সরকার ও প্রশাসনে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা অনেকটাই কেটে যায় গোলাপবাগে সমাবেশ সরিয়ে দেওয়ার পর। এর পর থেকেই সরকার বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং সরকার সমর্থকেরা প্রচার শুরু করেন, পরবর্তী নির্বাচনও তারা নিজেদের মরাজনীতির মাঠে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। না হলে রাজনীতির গতির সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে যায়। মূলত নেতৃত্বের হযবরল অবস্থা, কোন্দল ও অযোগ্য ব্যক্তিদের গণহারের পদায়নের কারণে বিএনপির মধ্যে দ্বিধা–দ্বন্দ, শঙ্কা, ভয়, অনিশ্চয়তা প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই মহাসচিব আটক হওয়ার পর দলটি কর্মীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশে বসেও আন্দোলন–সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার উদাহরণ ইতিহাসে অনেক আছে। এখন প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বা তার দল প্রযুক্তির সেই সুবিধা যথাযথভাবে নিতে পারছে না। চেয়ারখালি রাখা অনেক পুরোনো কৌশল। ডিজিটাল আমলে চেয়ার খালি রাখা কিছুটা হাস্যকরও বটে।
মনে হচ্ছে, বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কৌশলে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বিএনপির থিঙ্কট্যাংক নতুন নতুন আন্দোলনের কৌশল উদ্ভাবনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার দমন–নিপীড়ন করছে। এটা আমরা সবাই বলি। কিন্তু এই দমন–নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিএনপিকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। সহিংসতা না করেও সফল আন্দোলন করা যায়। প্রতিপক্ষের চাপ সব সময়ই রাজনীতিতে থাকবে। জনসমর্থন থাকার পরও বিএনপি এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্ব অনেকাংশেই একটি বিশেষ বিদেশি শক্তি ও প্রতিপক্ষের পক্ষের কবজায় চলে গেছে। এদের কাজ হচ্ছে ভয়ভীতি সঞ্চার করে বিএনপিকে আন্দোলন–সংগ্রাম থেকে দূরে রাখা। বাস্তবে হচ্ছেও তা–ই। ডিসেম্বরে বিএনপির মধ্যে যে গতি ছিল, তার অনেকটাই এখন থিতিয়ে গেছে। সামনে রোজা। ওই সময় আন্দোলন জমাতে পারবে না। তাই আবারও ঈদের পর আন্দোলনের গোলকধাঁধায় পড়ে যেতে পারে বিএনপি।তো করেই
করবে।বিএনপি এর আগে অনেকবার বলেছে যে ঈদের পর আন্দোলন হবে। কিন্তু সেই ঈদ আর বিএনপির আসেনি। এ জন্য বিএনপিকে নিয়ে অনেক তামাশাও হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর–অক্টোবর নাগাদ দলটি চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে চায়। কোনোভাবে যদি ওই সময় পর্যন্ত বিএনপির আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ টেনে নিতে পারে, তাহলে যেকোনো প্রকারে নির্বাচন করে ফেলবে। কারণ, নভেম্বরেই তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। আর সেপ্টেম্বর–অক্টোবরেই যদি চূড়ান্ত আন্দোলন করা হয়, তাহলে এখন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে সাধারণ কর্মীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? গত কয়েক মাসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির ৯ কর্মী নিহত হয়েছেন।প্রকৃতপক্ষে এ বছরের শেষ নাগাদ বিএনপি আন্দোলন করতে পারবে। কিন্তু ওই সময় পরিস্থিতির ওপর বিএনপির নিয়ন্ত্রণ না–ও থাকতে পারে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন আটকানো এই বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও পারেনি। এসব কারণে বিএনপির সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আগে থেকেই আছে। এই সন্দেহ থেকেই শরিকদের অনেকেই সরকারের প্রলোভন বা চাপের মুখে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। ঐক্য ফ্রন্টে যোগ দেওয়াকে ভুল ঘোষণা করে কাদের সিদ্দিকী এখন নৌকার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অপেক্ষোয় আছেন। এই প্রক্রিয়ায় অনেকেরই নাম শোনা যাচ্ছে। এমনকি বিএনপির অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। উকিল আবদুস সাত্তার এর বড় উদাহরণ। আজ যাঁরা রয়ে–সয়ে আন্দোলন করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিএনপিকে, তাঁরা আসলে প্রতিপক্ষের হয়েই কাজ করছেন। এদের মূল কাজ হচ্ছে, বিএনপিকে বিভ্রান্ত করে সরকারকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় করে দেওয়া। বিএনপিকে কোনোভাবে অক্টোবর পর্যন্ত টেনে নিতে পারলেই কেল্লাফতে।