প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বুধবার (৭ নভেম্বর) আবার সংলাপে বসতে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রোববার রাতে গণভবনে ১৪ দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট থেকে আবার সংলাপে বসতে চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই জানিয়েছিলেন যে, সংলাপের জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত। তবে ৭ নভেম্বরের পর সংলাপ সম্ভব নয়। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে ৭ নভেম্বর বেলা ১১টায় গণভবনে ছোট আকারে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ হবে।’
প্রথম দফার সংলাপে কাঙ্ক্ষিত সমাধান না পাওয়ায় ফের সংলাপ চেয়ে রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্যাডে ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিটি এদিন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ধানমণ্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে পৌঁছে দেন গণফোরামের তিন নেতা- অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, আ ও ম শফিক উল্লাহ এবং মোস্তাক হোসেন। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আলাউদ্দিন ও বিএম মাসুদুল হাসান এ চিঠি গ্রহণ করেন।
এদিকে রোববার বিকালে রাজধানীর মতিঝিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের চেম্বারে সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।
সেখানে ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফার সাংবিধানিক ও আইনগত দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে সংবিধানের আলোকে সংসদ ভেঙে নির্বাচন এবং সহায়ক সরকার গঠনে বিভিন্ন প্রস্তাব উঠে এসেছে।
এসব প্রস্তাব আজ (সোমবার) জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের কাছে দেয়া হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে এ প্রস্তাব দেয়া হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
প্রসঙ্গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে গত ১ নভেম্বর রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বহুল আলোচিত সংলাপে বসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২০ সদস্যের প্রতিনিধি দল ওই আলোচনায় অংশ নেয়। সংলাপ শেষে গণমাধ্যমকে ড. কামাল হোসেন বলেন, এ আলোচনায় বিশেষ কোনো সমাধান তারা পাননি।
এমন পরিস্থিতিতে আবার সংলাপ চেয়ে ড. কামাল হোসেন চিঠি দেন। এতে শেখ হাসিনার উদ্দেশে ড. কামাল লেখেন, ‘গত পহেলা নভেম্বর গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এ জন্য ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) ধন্যবাদ জানাই। দীর্ঘ সময় আলোচনার পরও আমাদের আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই দিন আপনি বলেছিলেন, আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
তারই ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট জরুরি ভিত্তিতে আবারও আলোচনায় বসতে আগ্রহী। ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফার সাংবিধানিক ও আইনগত দিক বিশ্লেষণের জন্য উভয় পক্ষের বিশেষজ্ঞসহ সীমিত পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন।’
ড. কামাল হোসেনের চিঠিতে সংলাপ শেষ হওয়ার আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চিঠি দেয়ার বিষয়টিও শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়।
শনিবার বিকালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে একটি চিঠি দেন ড. কামাল হোসেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সংবিধানের ভেতরে থেকেই সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দিতে চায় নয়া এ জোট। ফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপির তৈরি ‘সহায়ক সরকারের রূপরেখা’ সামনে রেখে এ প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে।
রোববার বিকালে রাজধানীর মতিঝিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের চেম্বারে অনুষ্ঠিত শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে এ রূপরেখা চূড়ান্ত করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, মুকাব্বির খান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও বিকল্পধারার শাহ আহম্মেদ বাদল। এ ছাড়া বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে অংশ নেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল ও ড. বোরহান উদ্দিন।
বৈঠকের শুরুতেই ড. শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সংবিধান ও আইনি কাঠামো পরিবর্তন সম্ভব। আইনজীবী হিসেবে আইনে কী কী কাঠামো আছে এ বিষয়গুলো তারা (ঐক্যফ্রন্ট নেতারা) জানতে চেয়েছেন। সে ব্যাপারে আলোচনা করে আমরা আলোকপাত করব। তারপর রাজনীতিবিদরা কী করবেন সেটা তাদের ব্যাপার।
তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে নির্বাচন করার সুযোগ সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে। সংবিধানের অন্তত ১০ জায়গায় এ কথা বলা আছে। বাংলাদেশে অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে এর বেশিরভাগই হয়েছে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে।
সংসদ রেখে নির্বাচন হলে সমস্য কী- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতে এক দলের সুযোগ-সুবিধা বেশি তাকে। নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না’। সংসদ মুলতবি রেখে নির্বাচন করার কথা সংবিধানের কোথাও নেই।
বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গণমাধ্যমের কাছে কিছু বলতে চাননি। তবে আগামী ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার বিষয়ে বলেন, তফসিল ফাইনাল কিছু নয়। সবকিছু নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। ফের সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমরা কাল (আজ) বিকাল ৫টায় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে আলোচনা হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপে এ রূপরেখা তার কাছে উপস্থাপন করা হবে। এতে সংবিধানের ভেতরে থেকেই কীভাবে সংসদ ভেঙে দিয়ে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায় এবং সেই সরকারে টেকনোক্র্যাট কোটায় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব থাকবে।
সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনও কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে: তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ খ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, ‘২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ আছে। সরকার যদি সেকেন্ড পজিশন অ্যাপ্লাই করে, তাহলে অটোমেটিক সংসদ থাকে না। এতে ঐক্যফ্রন্টের দাবি মানা হয়ে যায়।’
ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি- এই তিনটি সাংবিধানিক পদ মাথায় রেখে বিকল্প প্রস্তাবও তৈরি করা হবে। এ ছাড়া সংসদ ভেঙে দেয়ার প্রস্তাবের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তিনটি মন্ত্রণালয়- স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও তথ্যের দায়িত্ব নিরপেক্ষদের হাতে দেয়ার প্রস্তাব দেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সাত দফার মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টিও আছে।
এ ক্ষেত্রে ফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিরপেক্ষ একজনের নাম প্রস্তাব করা হতে পারে। প্রাথমিক আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যানের নাম এসেছে আলোচনায়।