দেশের মানুষের দৃষ্টি এখন বরিশাল ও খুলনায়। আজ এ দুই সিটিতে ইভিএমে ভোট। সিসিটিভি থাকবে অধিকাংশ কক্ষে। ঢাকায় নির্বাচন ভবন থেকে কমিশনাররা সিসিটিভির মাধ্যমে ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। বিশেষ করে বরিশালের দিকে রয়েছে ভিন্ন নজর। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধ। তার সঙ্গে রয়েছে চরমোনাইয়ের শক্তিশালী প্রার্থী। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ঘরের বিবাদের কারণে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপিবিহীন খুলনায় জাতীয় পার্টির সঙ্গে সহজেই নৌকার জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মাঠের সূত্রগুলো বলছে। গাজীপুরে হেভিওয়েট প্রার্থী পরাজয়ের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরিশাল ও খুলনাতে জয় পেতে মরিয়া। আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দলীয় প্রার্থীকে জয়ের বিষয় চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণায় গিয়েছেন। বিবাদ মেটাতে কাজ করেছেন। এ ছাড়া বিএনপি ভোটে না থাকলেও দুই সিটিতে ভোটের প্রভাব খাটচ্ছে। ভোটারদের কেন্দ্রে না যেতে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আ.লীগ তৃণমূলের ভোটের পরিস্থতি ঠিক রাখতে গেলো কয়েক দিন কেন্দ্রীয় নেতারা নির্ঘুম মাঠে পরিশ্রম করেছেন। তারা বলছেন, এ দুই সিটিতে আওয়ামী লীগ শতভাগ জিতে আসবে। বরিশাল খুলনায় আ.লীগ জয়ের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আ.লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, দুই সিটিতে নিশ্চিত জয়ের পথে হাঁটছি আমরা। বিশেষ করে জয় ঠেকানোর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী বরিশাল সিটিতে আর কেউ নেই। এই সিটিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থীর জোয়ার উঠেছে। নগরের উন্নয়নের জন্য মানুষ অবশ্যই আ.লীগের যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবেন। খুলনাতেও আমাদের শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছে। আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম আমার সংবাদকে বলেন, বিএনপি জামায়াত এবার নির্বাচনে না গিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। তারা যদি কোনোভাবে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় যেতে পারে, তাহলে বাংলাদেশটিকে তারা গিলে ফেলবে। বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেবে। দেশের অর্জনকে তারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ যে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তারা এমন আক্রমণ করবে, যাতে আর কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাঁড়াতে না পারে। তাই আমরা এ দেশের জনগণ ও ভোটারদের আহ্বান করব। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে উন্নয়নের পক্ষে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রায় দিতে আমাদের নেত্রী যে প্রার্থী দিয়েছেন সেই প্রার্থীকে ভোট দিন। আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন। আমরা বরিশালে গিয়েছিলাম সেখানে আমরা নৌকার জোয়ার দেখে এসেছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আজ বরিশাল এবং খুলনাতে নির্বাচন। সেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের হবে আশা রাখতে পারলেও এ নির্বাচন একেবারে সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। লড়াই হতে পারে এটি বলা যায় না। কারণ বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি মাঠে নেই। এবার তেমন প্রচারণা অতীতের ভোটের আমেজের মতো চোখে পড়েনি। জনগণ গ্রহণযোগ্য ও বিকল্প প্রার্থীর খোঁজ করবে তেমন কোনো প্রার্থী ও নেই।
বরিশালে উৎসবেও বহু হিসাব : বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে পুরো নগরীতে এখন উৎসবের আমেজ। এবার প্রার্থীরা হলেন আ.লীগের আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম, জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান। নির্বাচনে সাতজন মেয়র, ১১৮ জন সাধারণ ওয়ার্ডের ও ৪২ জন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। ৩০টি ওয়ার্ডে ১২৬টি কেন্দ্রের ৮৯৪ কক্ষে ভোটগ্রহণ হবে। এর মধ্যে ১০৬টি কেন্দ্রই গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) বলে জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পুলিশের হিসাবে ৭০টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রার্থীরা যেসব কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সেগুলো যুক্ত করে মোট ১০৬টিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভোটের প্রচারণায় আ.লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ.লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান, আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য মো. আনিসুর রহমান, মো. গোলাম কবির রাব্বানী চিনু, বরিশাল জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস, জাসদের মো. মহসিনসহ আরো অনেকে অংশগ্রহণ করেন এবং শেষ সময়ে আগাম ভি চিহ্ন দেখান বলে জানা গেছে। জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী ইকবাল হোসেন (তাপস) বলেন, মানুষ উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হবে কি-না, তা নিয়ে। এই নির্বাচনও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হয়ে যায় কি-না। সব আলামত ২০১৮ সালের আলামতের মতোই। রোগ একটাই। এবার আ.লীগের প্রার্থী আর আগেরবারের প্রার্থী একই পরিবারের। নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কার দিকে যাচ্ছে। ভোটারদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে আশার আহ্বান জানিয়েছেন চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি মো. ফয়জুল করীম। গতকাল রোববার দুপুরে এক বিশেষ ভিডিও বার্তায় ফয়জুল এ আহ্বান জানিয়ে ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো অপপ্রচারে কান দেবেন না।
কর্মীদের ভোট ঠেকাতে বিএনপির মনিটরিং সেল : সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থিতা ঠেকাতে না পেরে ১৯ জনকে বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। এবার দলীয় ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। দলটি চাইছে শুধু প্রার্থী নয়, সমর্থকদেরও ভোট দিতে নিরুৎসাহ করতে। এর পরও কেন্দ্রে যেতে পারেন কর্মী-সমর্থকরা। এ জন্যই মনিটরিং সেল গঠনের উদ্যোগ। বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, ‘যারা দলের নির্দেশনা অমান্য করে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। তেমনি ভোটার ও কর্মীদের প্রতি আমাদের আহবান, তারা যেন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে সরকারকে সহায়তা না করেন।’
১১৪৬ ক্যামেরা বসেছে : বরিশাল নগরের সব ভোটকেন্দ্র ও কক্ষে (বুথ) সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। গতকাল ক্যামেরাগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ১২৬টি কেন্দ্রের সবগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এক হাজার ১৪৬টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
খুলনায় ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জ : এবারের খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ১৮০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে পাঁচজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৩৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ও সংরক্ষিত ১০টি ওয়ার্ডে ৩৯ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। মেয়র প্রার্থীর মধ্যে হেভিওয়েট প্রার্থী আ.লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক। নগরবাসীর ধারণা, তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সহজেই জয় পাবেন নৌকার এই প্রার্থী। তারপরও নির্বাচনকে হাল্কাভাবে নেননি তিনি। এবারের নির্বাচনে আ.লীগের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচারের শুরু থেকেই খুলনা মহানগর ও জেলা আ.লীগ এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি তৎপর-১৪ দল : নির্বাচন বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা তৎপর বলে অভিযোগ করেছেন ১৪ দলের নেতারা। নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, তারা বিভিন্নভাবে অপপ্রচার ও বিশৃঙ্খলার আশ্রয় নিতে পারে। সচেতন নগরবাসীদের সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ১৪ দলের নেতাকর্মীরা ভোটে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। জাসদ (ইনু) নেতা মো. খালিদ হোসেনবলেন, নির্বাচন ক্ষমতা বদলের অন্যতম পথ হলেও বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাই নির্বাচনে ভয়। বিগত সময়ের মতো খুলনায় কখনো উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ১৪ দল সমর্থিত নৌকার প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেককে নির্বাচিত করতে হবে।
১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন : নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে খুলনা মহানগরীতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। শনিবার থেকে তারা ভোট কেন্দ্রসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টহল শুরু করেছে। খুলনা বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর রহমান জানান, কেসিসি নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে ২০ জন করে মোট ২২০ জন বিজিবি সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতি দলে চার থেকে পাঁচজন অফিসার দায়িত্বে রয়েছেন।