নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে জুলাই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ ঘোষণা করেছিলেন প্রবাসীরা। এতে ডলার বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অবাধে রেমিট্যান্স পাঠাতে থাকে প্রবাসীরা। বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বাড়ায় তিন থেকে চার মাস স্থিতিশীল ছিল ডলার বাজার। তবে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের বাজারে আবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে হচ্ছে বেশি টাকায়। এতে আমদানিকারকদের খরচও বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর বেড়েছে।
পট পরিবর্তনের পর তিন থেকে চার মাস ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ছিল নিম্নমুখী। চাহিদা কমে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের বিনিময় হার নেমেছিল ১২১ টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দরের কাছাকাছিতেই বিক্রি হচ্ছিল খোলা বাজারে। কিন্তু হঠাৎ করেই খোলা বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ১২৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে ডলার।
ব্যাংকগুলোর ঘোষিত দর অনুযায়ী, প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ১২০ টাকা। কিন্তু চাহিদার কারণে ব্যাংকগুলোয় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক এখন রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে ১২৫ টাকায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর দিলকুশা ও পল্টন ও গুলশানের মানি চেঞ্জারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সকালের দিকে তারা ডলার কিনেছেন ১২৬ টাকা থেকে ১২৬ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত। বিক্রি করেছেন ২৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৯০ পয়সা পর্যন্ত। এক মাস আগে প্রতি ডলার বিক্রি হতো ১২২ টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ৫ টাকা বেড়েছে ডলার প্রতি।
ক্রেতা পরিচয়ে রাজধানীর গুলশানের বুশরা মানি এক্সচেঞ্জার লিমিটেডে যোগাযোগ করা হলে সেখানকার প্রধান ফজলুর রহমান বলেন, আপনি কত ডলার কিনবেন তার ওপর দাম। আজ ১২৮ টাকা দরে বিক্রি করছি। ১২৭ টাকা আমাদেরই কেনা পড়ছে। কালকের দর কী হবে এখন বলা যাচ্ছে না। ডলারের দাম আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে ক্রেতা পরিচয়ে দিলকুশার বিএনকে মানি এক্সচেঞ্জারের ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ১২৬ টাকা ৭০ পয়সা পর্যন্ত কিনছি। বিক্রি করলে নিয়ে আসেন। কাল (শুক্রবার বন্ধ), শনিবারে আসেন। বাজার অনুযায়ী দাম পাবেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে ডলারের দর বাড়ছে। প্রথমত, রমজান কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে গতি বেড়েছে। এতে আমদানি দায় পরিশোধের চাহিদাও বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএফএফ) শর্ত অনুযায়ী বছর শেষে নির্ধারিত পরিমাণে রিজার্ভ সংরক্ষণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওভারডিউ (বকেয়া) হয়ে যাওয়া সব ঋণপত্রের (এলসি) দায় ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বেশি দামে ডলার কিনে হলেও এলসি দায় সমন্বয় করছে।
এদিকে, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ন্যূনতম ১ হাজার ৫৩২ কোটি বা ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। এ শর্ত পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা বাড়ানোর বিষয়টিও মার্কিন মুদ্রাটির বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, টানা দুই অর্থবছর আমদানি ঋণাত্মক থাকার পর চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে ২২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২১ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। নভেম্বর ও চলতি মাসে আমদানির এলসি খোলাও বেড়েছে।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে, তখন ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় ডলার বিক্রি করলেও দর ঠেকানো যায়নি। আবার অনেক ধরনের বকেয়া পরিশোধ না করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে টানা তিন অর্থবছর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি বা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর তা আরও বেড়ে পৌঁছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়নে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় আরও ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। টানা তিন অর্থবছর ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভে বড় ক্ষয় হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নে)। সে রিজার্ভ এখন ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখতে হবে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছেন। সেই সঙ্গে আইএমএফের শর্ত পূরণে বাজার থেকে ডলার কিনছেন।
চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স। জুলাই থেকে নভেম্বরে (পাঁচ মাসে) প্রবাসীরা ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। আর জুলাই থেকে অক্টোবর এ চার মাসে রপ্তানিতে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।