সাকিব আল হাসানের সেঞ্চুরি ও লিটন দাসের হাফ-সেঞ্চুরিতে দ্বাদশ বিশ্বকাপে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে দাপুটে জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। আজ বিশ্বকাপের ২৩তম ম্যাচে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে হারিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এই জয়ে ৫ খেলায় ৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের পঞ্চমস্থানে উঠে এলো বাংলাদেশ। সমানসংখ্যক ম্যাচে ৩ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তমস্থানে নেমে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সাকিব ১২৪ ও লিটন ৯৪ রানে অপরাজিত থাকেন। নিজেদের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে আজ সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে ম্যাচ জয়ের রেকর্ডও গড়লো বাংলাদেশ।
টনটনের দ্য কুপার অ্যাসোসিয়েটস কাউন্টি গ্রাউন্ডে টস জিতে প্রথমে বোলিং বেছে নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। অর্থাৎ, রান চেজ করে ম্যাচ জয়ের পরিকল্পনা তার। এর পেছনে যুক্তিটাও বেশ মজবুত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে সর্বশেষ ছয় মুখোমুখিতে পাঁচটি জয় ছিলো বাংলাদেশের। পাঁচটি জয়ই বাংলাদেশের এসেছে রান চেজ করে। তাই এবারও আগের পরিকল্পনায় সাফল্য পাবার পথেই হাটলেন মাশরাফি।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে নিয়ে বাংলাদেশের বোলিং ইনিংস ওপেন করেন মাশরাফি। মাশরাফি-সাইফউদ্দিনের বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং-এ প্রথম তিন ওভারে মাত্র ৬ রান তুলতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ওপেনার ক্রিস গেইল ও এভিন লুইস। তবে চতুর্থ ওভারে ও নিজের দ্বিতীয় ওভারেই বাংলাদেশকে প্রথম সাফল্য এনে দেন পেসার সাইফউদ্দিন। দলীয় ৬ রানে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলকে শূন্য রানে বিদায় দেন সাইফ। ১৩ বল খেলে রানের খাতাই খুলতে পারেননি স্বঘোষিত ‘ইউনিভার্স বস’। বাঁ-দিকে ঝাপিয়ে পড়ে উইকেটের পেছনে গেইলের দুর্দান্ত ক্যাচ নেন উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিম।
তবে শুরুতেই গেইলকে হারানোর ধাক্কা ভালোভাবেই সামাল দেন লুইস ও তিন নম্বরে নামা শাই হোপ। বাংলাদেশ বোলারদের দেখে-শুনে খেলে রানের চাকা সচল রাখেন তারা। ফলে ২৩তম ওভারেই শতরানের কোটা স্পর্শ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এসময় হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন লুইস। হাফ-সেঞ্চুরির পর বেশি দূর যেতে পারেননি তিনি। তাকে ব্যক্তিগত ৭০ রানে থামিয়ে দেন বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান। ৬৭ বল মোকাবেলা করে ৬টি চার ও ২টি ছক্কা মারেন লুইস। দ্বিতীয় উইকেটে হোপের সাথে ১২৭ বলে ১১৬ রান যোগ করেন লুইস।
লুইসের বিদায়ে উইকেটে গিয়ে হোপের সাথে বড় জুটি গড়ার চেষ্টা করেন নিকোলাস পুরান। কিন্তু তাকেও বেশি দূর যেতে দেননি সাকিব। ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩০ বলে ২৫ রান করা পুরানকে থামান সাকিব।
৩তম ওভারে ১৫৯ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারানোর পর বড় জুটির আশা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর ক্যারিবীয়দের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে ছক কষেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের অধিনায়কের ছককে দুমড়ে-মুষড়ে দেন শিমরোন হেটমায়ার। বাংলাদেশের বোলারদের উপর চড়াও হন তিনি। ফলে ২৫ বলেই হাফ-সেঞ্চুরি তুলে ফেলেন তিনি। আর ব্যক্তিগত ৫০ রানেই থেমে যান হেটমায়ার। বিধ্বংসী রুপে থাকা হেটমায়ারকে আউট করেন মুস্তাফিজুর রহমান। তৃতীয় উইকেটে হোপের সাথে দলকে ৪৩ বলে ৮৩ রান উপহার দেন হেটমায়ার।
২৪২ রানে যখন হেটমায়ার ফিরেন তখন উইকেটে আসেন আরেক বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান আন্দ্রে রাসেল। তখন ৪০তম ওভার চলছিলো। ঐ ওভারের তৃতীয় বলে হেটমায়ারকে এবং শেষ বলে রাসেলকে তুলে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বড় স্কোরের আশা শেষ করে দেন ফিজ। শুন্য হাতে ফিরেন বিগ হিটার রাসেল।
এ অবস্থায় উইকেটে রাসেলের কাজটা করার চেষ্টা করেন অধিনায়ক হোল্ডার। দ্রুতই রান তুলতে থাকেন তিনি। তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তিন নম্বরে নামা হোপ। ততক্ষণে হাফ-সেঞ্চুরি তুলে এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন হোপ। সেঞ্চুরির পথেই হাটছিলেন হোপ। আর অন্যপ্রান্ত দিয়ে দ্রুত রান তুলতে থাকেন হোল্ডার। তাতে আবারো বড় স্কোরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষ পর্যন্ত ১৫ বলে ৩৩ রান করে থামেন হোল্ডার। ৪টি চার ও ২টি ছক্কা মারা হোল্ডারকে থামান সাইফউদ্দিন।
কিছুক্ষণ বাদে হোপকে থামিয়েছেন মুস্তাফিজ। নার্ভাস-নাইন্টিতে আউট হন হোপ। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুর্দান্ত ফর্ম প্রদর্শন করা হোপ আউট হন ৯৬ রানে। ১২১ বল মোকাবেলা করে মাত্র ৪টি চার ও ১টি ছক্কা মারেন হোপ। হোপ বিদায় নিলেও, শেষদিকে ড্যারেন ব্রাভোর ১৫ বলে ১৯ রানের উপর ভর করে ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ৩২১ রানের সংগ্রহ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের সাইফউদ্দিন ৭২ রানে ও মুস্তাফিজ ৫৯ রানে ৩টি করে ও সাকিব ৫৪ রানে ২টি উইকেট নেন।
৩২২ রানের বড় টার্গেটে খেলতে নামে বাংলাদেশ। তখনও হয়তোবা ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন দেখেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমিরা। কারন ততক্ষণে মোবাইলে ঘাটাঘাটি শুরু করে সমর্থকরা জানতে পারে ৩১৯ রানের টার্গেট তাড়া করে ৩২২ রান তুলে গত বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতেছিলো বাংলাদেশ। সেবার প্রতিপক্ষ ছিলো স্কটল্যান্ড। এবার তো প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারপরও হাল ছাড়ার দল এখন নয় বাংলাদেশ। তাই দু’ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার ইনিংস শুরু করেই দ্রুত রান তুলতে থাকেন। ৮ ওভারেই ৪৬ রান যোগ করেন ফেলেন তারা। নবম ওভারের প্রথম বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেসার রাসেলকে ছক্কা মারেন সৌম্য। কিন্তু পরের বলেই আউট হয়ে যান তিনি। ২টি করে চার-ছক্কায় ২৩ বলে ২৯ রান করেন সৌম্য। আজও ভালো শুরুর পর দলীয় ৫২ রানে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন তিনি।
সৌম্যকে হারানোটা আমলে নেননি তিন নম্বরে নামা দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব। উইকেটে গিয়েই প্রতিপক্ষ বোলারদের উপর চড়াও হন। সাকিবের সাথে তাল মেলাচ্ছিলেন তামিম। তাই ১৪তম ওভারে বাংলাদেশ পেয়ে যায় শতরান। তবে হাফ-সেঞ্চুরির পথে ছিলেন তামিম। কিন্তু এবারও হলো না তামিমের হাফ-সেঞ্চুরি। ৬টি চারে ৫৩ বলে ৪৮ রান করে রান আউট হন তামিম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলার শেলডন কটরেলকে সোজা ব্যাটে খেলেন তামিম। বল গিয়ে পৌছায় কটরেলের হাতে। বল পেয়েই পাল্টা থ্রো করে তামিমের স্ট্রাইকের উইকেট ভেঙ্গে দেন কটরেল।
এরপর উইকেটে গিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিম। ১ রান করে থামেন তিনি। তাই ১৩৩ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। এসময় ৩১ ওভারে ১৮৯ রান দরকার ছিলো বাংলাদেশের। উইকেট হাতে ছিলো ৭টি।
মোহাম্মদ মিঠুনের পরিবর্তে এবারের আসরে প্রথমবারের মত সুযোগ পান লিটন দাস। চতুর্থ উইকেটে সাকিবের সাথে জুটি বাঁধেন লিটন। তখন ৩৯ বলে ৪৯ রানে দাঁড়িয়ে সাকিব। হাফ-সেঞ্চুরি তুলে আরও বেশি মারমুখী হয়ে উঠেন সাকিব।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের লাইন-লেন্থহীন করে দিয়ে সহজেই স্কোরবোর্ডে রান জমা করছিলেন সাকিব। নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি লিটনও। সাকিবের সাথে রান তোলার কাজটা ভালোই করছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে ৩৪তম ওভারের শেষ বলে নিজের ৮৩তম বলে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন সাকিব। এবারের আসরে দ্বিতীয় ও ওয়ানডে ক্যারিয়ারের নবম সেঞ্চুরি তুলে নেন বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার।
সাকিবের সেঞ্চুরি ও লিটনের ৪০ বলে ৪৭ রানে ৩৪ ওভার শেষে ৩ উইকেটে ২৪৮ রান তুলে ম্যাচ জয়ের পথ পেয়ে যায় বাংলাদেশ। এতে আরও নির্ভার হয়ে পড়েন সাকিব-লিটন জুটি। এমন অবস্থায় ৩৮তম ওভারের প্রথম তিন বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শ্যানন গাব্রিয়েলকে পরপর তিনটি ছক্কা মারেন লিটন। এরপর ম্যাচ শেষ করতে খুব বেশি সময়ক্ষেপন করেননি সাকিব-লিটন। ৫১ বল বাকী রেখেই ম্যাচ শেষ করেন সাকিব-লিটন। চতুর্থ উইকেটে ১৩৫ বলে অবিচ্ছিন্ন ১৮৯ রান যোগ করেন তারা।
সাকিব ১৬টি চারে ৯৯ বলে ১২৪ এবং ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরির স্বাদ নেয়া লিটন ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় ৬৯ বলে ৯৪ রানে অপরাজিত থাকেন লিটন। ম্যাচ সেরা হয়েছেন সাকিব।
আগামী ২০ জুন নটিংহামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবারের আসরে নিজেদের ষষ্ঠ ম্যাচ খেলতে নামবে বাংলাদেশ।
স্কোর কার্ড :
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং :
ক্রিস গেইল ক মুশফিকুর ব সাইফউদ্দিন ০
এভিন লুইস ক সাব্বির (অতিরিক্ত) ব সাকিব ৭০
শাই হোপ ক লিটন ব মুস্তাফিজ ৯৬
নিকোলাস পুরান ক সৌম্য ব সাকিব ২৫
শিমরোন হেটমায়ার ক তামিম ব মুস্তাফিজুর ৫০
আন্দ্রে রাসেল ক মুশফিক ব মুস্তাফিজ ০
জেসন হোল্ডার ক মাহমুদুল্লাহ ব সাইফউদ্দিন ৩৩
ড্যারেন ব্রাভো বোল্ড ব সাইফউদ্দিন ১৯
ওশানে থমাস অপরাজিত ৬
অতিরিক্ত (লে বা-৬, ও-১৬) ২২
মোট (৮ উইকেট, ৫০ ওভার) ৩২১
উইকেট পতন : ১/৬ (গেইল), ২/১২২ (লুইস), ৩/১৫৯ (পুরান), ৪/২৪২ (হেটমায়ার), ৫/২৪৩ (রাসেল), ৬/২৮২ (হোল্ডার), ৭/২৯৭ (হোপ), ৮/৩২১ (ব্র্রাভো)।
বাংলাদেশ বোলিং :
মাশরাফি : ৮-১-৩৭-০,
সাইফউদ্দিন : ১০-১-৭২-৩ (ও-৬),
মুস্তাফিজ : ৯-০-৫৯-৩ (ও-৫),
মিরাজ : ৯-০-৫৭-০ (ও-১),
মোসাদ্দেক : ৬-০-৩৬-০,
সাকিব : ৮-০-৫৪-২।
বাংলাদেশ ব্যাটিং :
তামিম ইকবাল রান আউট (কটরেল) ৪৮
সৌম্য সরকার ক গেইল ব রাসেল ২৯
সাকিব আল হাসান অপরাজিত ১২৪
মুশফিকুর রহিম ক হোপ ব থমাস ১
লিটন দাস অপরাজিত ৯৪
অতিরিক্ত (বা-১, ও-২৫) ২৬
মোট (৩ উইকেট, ৪১.৩ ওভার) ৩২২
উইকেট পতন : ১/৫২ (সৌম্য), ২/১২১ (তামিম), ৩/১৩৩ (মুশফিক)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলিং :
কটরেল : ১০-০-৬৫-০ (ও-৩),
হোল্ডার : ৯-০-৬২-০ (ও-১),
রাসেল : ৬-০-৪২-১ (ও-১),
গ্যাব্রিয়েল : ৮.৩-০-৭৮-০ (ও-২),
থমাস : ৬-০-৫২-১ (ও-৫),
গেইল : ২-০-২২-০ (ও-১)।
ফল : বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।