শুধু অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমেই বছরে পাচার করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। স্ট্রিমকার নামে সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপসের মাধ্যমে এই জুয়া পরিচালনা করা হয়। সম্প্রতি রাজধানী থেকে চার জনকে গ্রেফতারের পর বিদেশে টাকা পাচারের এই নেটওয়ার্ক ধরা পড়ে। সারা দেশেই এই চক্রের নেটওয়ার্ক সচল রয়েছে। স্ট্রিমকার নামের অ্যাপসটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও ভিপিএনের মাধ্যমে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ব্যবহার-প্রসারে হাতে গোনা কয়েক জন জড়িত থাকলেও না বুঝে ব্যবহার করছেন লক্ষাধিক বাংলাদেশি।
পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের এসপি মাহিদুজ্জামান জানিয়েছেন, এই নেটওয়ার্কের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। আরও যারা এর সঙ্গে আছেন, তাদেরও গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি এক নারীসহ যে চার জন গ্রেফতার হয়েছেন, তারা জানিয়েছেন পাচার প্রক্রিয়ার আদ্যোপান্ত। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—জমির উদ্দিন (৩৫), মো. হোসেন রুবেল (৩৯), ইসলাম হৃদয় (২৬) ও অনামিকা সরকার (২৪)। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছেন কীভাবে চলে এই জুয়া আর কারা অংশ নিচ্ছে এখানে। স্ট্রিমকার অ্যাপসে গ্রুপ চ্যাট, লিপ সিং, ড্যান্স, গল্প, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন জুয়া খেলার অপশন রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের এই অ্যাপে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি হচ্ছে ইউজার আইডি, অন্যটি হোস্ট আইডি। ইউজাররা সাধারণত সুন্দরী মেয়েদের ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য এই অ্যাপ ব্যবহার করেন। আর হোস্টরা একটি হোস্ট এজেন্সির মাধ্যমে এই অ্যাপে হোস্টিং করেন। সুন্দরী মেয়ে ও সেলিব্রেটিরাই সাধারণত এই এজেন্সির মাধ্যমে হোস্ট আইডি খোলেন।
যেভাবে এখানে লেনদেন ও পাচার হচ্ছে: হুন্ডি, হাওয়ালা ও একটি ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ অর্থ বিদেশে পাচার করেন এজেন্সির মালিকেরা। ঐ অ্যাপের এজেন্সিগুলো পাশের দেশ থেকে নগদ অর্থ দিয়ে অ্যাপের মুদ্রা বা বিনস কিনে আনেন। বিনস হলো অ্যাপের ভার্চুয়াল মুদ্রা, যেটি দিয়ে আড্ডা বা জুয়া খেলার সুযোগ পাওয়া যায়। বিনস দেশে কেনাবেচার ব্যবস্থা না থাকায় অর্থ পাচারের মাধ্যমে তা করা হয়। অর্থ পাচার ব্যবস্থাপনায় এ দেশের কয়েকটি এজেন্সি দুবাইয়ে অফিসও খুলে বসেছে। ঐ অফিসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশি গ্রাহকদের অর্থ তারা সেদেশ থেকে নগদায়ন (ক্যাশ) করে, যেগুলো আর কখনোই দেশে আসে না। চ্যাটের পাশাপাশি জুয়ায় প্রচুর বিনস ওড়ান প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই স্ট্রিমকারের উদ্যোক্তা একজন মার্কিন নাগরিক। তবে বাংলাদেশে মূলত ভারত ও পাকিস্তান থেকে অ্যাপটি পরিচালনা করা হয়। এটির দর্শক বা ব্যবহারকারী মূলত বাংলা, হিন্দি ও উর্দুভাষীরা।
বাংলাদেশিদের মধ্যে কেন এত জনপ্রিয়: ইন্টারনেটে ঢুকলে বিগোসহ বিভিন্ন ধরনের লাইভ চ্যাটের বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। তবে স্ট্রিমকারের বিশেষত্ব হলো এটিতে হাজারের ওপরে বাংলাদেশি তরুণী, কিশোরী ও তারকারা যুক্ত রয়েছেন। বিগোতে ভিয়েতনামি তরুণীদের সংখ্যা বেশি। ভাষাগত তারতম্যের কারণে বাংলাদেশিরা ঐ অ্যাপগুলো পছন্দ করেননি। এ কারণে বাংলাভাষীদের বাজার দখল করে রেখেছে স্ট্রিমকার।
হোস্টদের বেতন কত?: সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাপের নিয়মানুযায়ী একজন হোস্টকে মাসে ৪০ ঘণ্টা লাইভে থাকতে হয়। বেতন পেতে হলে একজন হোস্টের অ্যাকাউন্টে মাসে ন্যূনতম ২০ লাখ বিন্স (বা জেমস) জমাতে হয়। ২০ লাখ বিনস জমালে ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা বেতন পান একজন হোস্ট। হোস্ট হওয়ার জন্য ফেসবুকে পেইজ খুলেও পোস্ট দেওয়া হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, স্যালারিশিটে তারা দেখেছেন অনেক হোস্টের বেতন লাখের কাছাকাছিও পরিশোধ করা হয়েছে। তবে তাদের যে বেতন দেওয়া হয়, তা গ্রাহকদের কাছ থেকে তাদের উপার্জিত অর্থের সামান্য অংশ। এসপি মাহিদুজ্জামান বলেন, চেষ্টা চলছে দেশের ভেতরে এজেন্সিগুলোর চক্র ভেঙে দেওয়ার জন্য। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
যেভাবে চলে এই অ্যাপ: চাইলেই কেউ সরাসরি অ্যাপে যুক্ত হতে পারেন না। প্রথমে যে কোনো একটি এজেন্সির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে ‘বিনস’ নামে পরিচিত অ্যাপের মুদ্রা কিনতে হয়। ১ লাখ বিনস কিনতে খরচ হয় ১ হাজার ৮৮ টাকা। ঐ টাকায় চ্যাটরুমে ঢুকে পছন্দমতো তরুণী বা তারকাকে বিনস ‘উপহার’ পাঠাতে হয়। এরপর তাদের চ্যাটরমে যুক্ত করা হয়, যেখানে নানান আলাপের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আড্ডা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ঐ বিনস ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি ব্যবহারকারী আড্ডার বদলে ঐ অ্যাপে থাকা জুয়া খেলতে বসে যান। অ্যাপটিতে তিন পাত্তি, ট্রেজার হান্ট, লাকি পয়সা, ক্রিকেট স্টারস ইত্যাদি নামে ছয়টি জুয়া আছে। প্রতি তিন মিনিটে একটি করে জুয়ার বোর্ড ‘ওঠে’ বা সমাপ্ত হয়। প্রতিদিন মিনিটে জুয়া থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা উঠিয়ে নেয় তারা।
কত মানুষ যুক্ত এখানে: স্যালারিশিট অনুযায়ী শতাধিক তরুণীর আইডি নাম, বিকাশ নম্বর ও দেনা-পাওনার বিবরণী রয়েছে। একটি এজেন্সির ‘স্যালারিশিট’ থেকে ধারণা করা যায়, অ্যাপটির সঙ্গে অন্তত ১ হাজার তরুণী যুক্ত। তারা হোস্ট হিসেবে লাইভে উপস্থিত হয়ে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে ‘আড্ডা’ দেন। দেশেই আছে বেশ কিছু এজেন্সি।
এটিইউর সাইবার অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে এই অ্যাপসের ১১ জন এজেন্ট রয়েছে। তারাই ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি কেনাবেচা করেন। লক্ষাধিক বাংলাদেশি ইউজার বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডি, হাওয়ালা, ক্রিপ্টো কারেন্সি এবং বিদেশি একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি কিনছেন, যার মাধ্যমে প্রতি মাসে শত কোটির বেশি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।