বর্তমান যুগ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর এই বৈপ্লবিক উত্থান। প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় আছে প্রযুক্তি আমাদের যা দিয়েছে তার দ্বিগুণ কেড়ে নিয়েছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি একদিকে যেমন আমাদের জীবনকে সহজ-সরল সাবলীল করে তুলেছে, ঠিক তেমনি এর বহুল ব্যবহারের ফলে দিন দিন বেড়ে চলছে সন্ত্রাস ও সহিংসতা। এক দশক আগেও কিন্তু এমন চিত্র ছিল না।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, আমাদের শৈশব কেটেছে গ্রামবাংলার ধুলো মাখা শরীরে। ছিল পল্লীজুড়ে প্রচলিত নানারকম খেলাধুলা ও সময় কাটানোর বিভিন্ন ধরন। বিনোদনের জন্য দলবেঁধে ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, গোল্লাছুট, লুকোচুরি, নৌকাবাইচ, বদন, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদিসহ নানা রকম খেলায় কেটেছে রঙিন শৈশব। এ ছাড়া সময় কাটানোর মতো কত্ত মজাদার মাধ্যম ছিল! জোছনাভরা রাতে উঠানে পরিবারের সব সদস্য দাদা-দাদির কাছে পরিদের গল্প শোনা, ছোট-বড় একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি। ফলে পরিবারের একে অন্যের সঙ্গে তৈরি হতো এক নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একই মায়া ডোরে যেন বাধা ছিল সব প্রাণ। কালের ঘূর্ণাবর্তে সবকিছুর পালাবদল ঘটছে। পরিবর্তন এসেছে জীবনের রূপ ও রঙে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন চিন্তা এসে গ্রাস করছে পুরোনো চিন্তার জগৎ।
বিকালবেলায় মাঠে গিয়ে খেলা করা, বন্ধুরা মিলে বাইরে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, পরিবারের সঙ্গে বসে গল্প করা, নতুন প্রজন্মের কাছে নিছকই বিরক্তিকর। কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে বসে আড্ডা দিলেও সবার চোখ থাকে ফোনের চার কোনার স্ক্রিনে। এখন আর কেউ কাউকে সময় দেয় না। ফলে সম্পর্কগুলো যেন একেবারেই ঠুনকো হয়ে গেছে। এখন বিনোদনের জন্য বেছে নিয়েছে অনলাইন গেমস, পাবজি, ফ্রি ফায়ার। বিকাল হলে শিশু-কিশোরদের আর মাঠে খেলতে দেখা যায় না। বাড়ির কোনো এক কোনায় বসে মত্ত হয়ে উঠে অনলাইন ভিডিও গেমস খেলায়। চার কোনার স্ক্রিনে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বর্তমানে শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও গেমস পাবজি ও ফ্রি ফায়ার; যা আজকাল মাত্রাতিরিক্ত খেলতে দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি ব্লু-হোয়েল এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত গেম Player Unknown Battle Ground (PUBG) অনলাইন গেমস তথা পাপজি ও ফ্রি ফায়ার শিশু-কিশোরদের জন্য হয়ে উঠেছে সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
পাবজি গেম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিত্যক্ত একটি দ্বীপে ১০০ জন মানুষ থাকে। সেখানে প্যারাসুট দিয়ে নামে খেলোয়াড়। এরপর শুরু হয় টিকে থাকার যুদ্ধ। চারজনের গ্রুপ করেই এটি খেলা যায়। ওই চারজন খেলোয়াড় ১০০ জনকে হত্যার মহা-আয়োজনে মেতে উঠে। এই গেমের মূল উপজীব্য হচ্ছে, হত্যা করে টিকে থাকতে হবে। ‘টু সারভাইভ, নিড টু মোর কিল’ এটাই হচ্ছে এই গেমের মূলমন্ত্র। ফ্রি ফায়ারও এই গেমের আদলেই তৈরি।
বিশ্ব পরিসংখ্যানে এই দুটি গেমই সবচেয়ে বেশি খেলা হচ্ছে। একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে প্রতিদিন ৮৭ কোটি মানুষ পাবজি ফ্রি ফায়ার খেলছে। গুগল প্লে স্টোর থেকে প্রতিদিন ডাউনলোড হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি। একাধিক অনলাইন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশেও প্রতিদিন এক কোটির বেশি গেম খেলার পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে, সন্ত্রাস ও সহিংসতার গেম ফ্রি ফায়ারও পিছিয়ে নেই। বিশ্বে ফ্রি ফায়ার খেলছে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। বাংলাদেশে খেলছে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। বিশ্বজুড়ে আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিং আসক্তিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী (সূত্র : জেওয়াউ ফ্যাম, ২০১৮)।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসির তথ্যমতে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের এক তথ্যমতে, ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরী। এরাই কিন্তু বর্তমান গেমিংয়ে বেশি আসক্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১) ‘গেমিং অ্যাডিকশন’কে এক মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুনে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগ নির্ণয় গাইডবুকে এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা এসব গেম তৈরি করছে তারা নিজেদের সন্তানকে এসব আবহ থেকে দূরে রাখছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য বোধহীন অনুগত আগামী প্রজন্ম তৈরি করা।
জনপ্রিয় ডিজিটাল প্রতিটি গেমই ভয়ংকর সন্ত্রাস-সহিংসতা যুদ্ধ আর মৃত্যুর গল্প দিয়ে রচিত। অস্ট্রেলিয়ার দিয়াকিন ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. হেলেন ইয়ং তার ‘ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য ফার-রাইটস’ নিবন্ধে লিখেছেন, সন্ত্রাসনির্ভর ভিডিও গেমগুলো সন্ত্রাস-সহিংসতার সাধারণীকরণের ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে মানুষের ভেতরের অপরাধপ্রবণতাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। হত্যা-খুনকে স্বাভাবিক হিসেবে ভাবতে শেখানো হচ্ছে তরুণদের। মানুষের মধ্যে নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় কাউকে অন্যায়ভাবে মারা হলেও এখন কেউ আর এগিয়ে আসে না। গেম নির্মাতাদের মূল লক্ষ্য ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করা। বাস্তবেও বিশ্বের কোটি কোটি কিশোর-তরুণ ভিডিও গেমে আসক্ত। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিনষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে পড়ছে মেধাহীন। এ আসক্তি তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আসক্তি কখনো কখনো আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথও বেছে নিচ্ছে। গত ২১ মে শাজাহানপুরে মোবাইল ফোনে ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলতে না পেরে মায়ের ওপর অভিমান করে উম্মে হাবিবা বর্ষা নামে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে।
এসব গেম খেলতে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত ডেটার। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুরে ফ্রি ফায়ারের ডেটা কেনার টাকা জোগাড় করতে না পারায় রিপন নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক এক জরিপে দেখা গেছে, এ বছর ভিডিও গেমকে কেন্দ্র করে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ১৭ জন। অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে আত্মহত্যার তালিকা ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা ভিডিও গেমের আসক্তিকে মাদকের চেয়েও ভয়ংকর বলে উল্লেখ করেছে। যার নাম দিয়েছে ‘ডিজিটাল ড্রাগ’। একজন মাদকাসক্ত মাদক না পেলে যেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে; ঠিক তেমনই অনলাইন গেমে আসক্তরা গেম খেলতে না পেরে আত্মহত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। মাদকাসক্তির মতোই অনলাইন গেম থেকেও বের হয়ে আসা অনেক কঠিন। তবে তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও সাংস্কৃতিকচর্চা বা সেবামূলক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে গেম আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।
এই গেমের ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, জাপান, ইরানসহ আরো অনেক দেশ পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশেও এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও অদৃশ্য কারণে বন্ধ করা যায়নি। তরুণ প্রজন্মকে আসক্তি থেকে মুক্ত করতে না পারলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশেও এসব সন্ত্রাসনির্ভর গেম অচিরেই বন্ধ করা জরুরি। তাছাড়া এ ব্যাপারে অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়া দরকার। সন্তানদের অনলাইন দুনিয়ায় মানবিক ও সুস্থ বিনোদনের উপায়গুলোর সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়া। তাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষার অগ্রহী করে তোলা। মাঠে গিয়ে খেলাধুলার ব্যবস্থা করা। তরুণ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এবং বিশ্বদরবারে তাদের সফলতার শিখরে পৌঁছাতে মাদকাসক্তিকে না বলার মতো অনলাইন গেমের প্রতি তরুণদের আসক্তিকেও না বলতে হবে, তাহলেই সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলবে। মনে রাখতে হবে, এখন ক্ষত ছোট, ওষুধ দিলে সেরে যাবে, কিন্তু ক্ষত বড় হলে তা সারানো মুশকিল হয়ে পড়বে। তাই আসুন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনি।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
abdulhakimjubair@gmail.com