মাহবুব মমতাজীকরোনা মহামারী শুরুর পর গত এক বছরে সৌদি আরবে শতাধিক নারী পাচারের শিকার হয়েছেন। একটি চক্র তাদের বেশি বেতনে গৃহকর্মীর চাকরির লোভ দেখিয়ে ওই দেশে পাচার করে। চাকরির কথা বললেও চক্রটি সৌদি নাগরিকদের কাছে এসব নারীকে বিক্রি করে দিয়েছে। জনপ্রতি চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ৪ লাখ টাকা করে। এভাবে এক বছরে নারী পাচার করে ৪০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।
নারী পাচারের অভিযোগে রাজধানীর বিজয়নগরের গ্রিন এক্সিলেন্ট ড্রিম ওভারসিজের মালিক বদিউল আলম খান ও তার সহযোগী আরমানকে গ্রেফতারের পর এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির পরিদর্শক রাসেল আহমেদের নেতৃত্বে ৩ আগস্ট শাহবাগ থেকে এ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ১৭ জুলাই রাজধানীর পল্টন থানায় মানব পাচার আইনে মামলা করেছিলেন ময়মনসিংহের ফাহিমা। এ মামলার তদন্ত করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে সৌদিতে নারী পাচারের ভয়াবহ তথ্য।
সিআইডি-সূত্র জানান, এ বছরের শুরুতে গাজীপুরের একটি গার্মেন্টে চাকরি নেন ফাহিমা। সেখানে একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে ঢাকায় আসেন। এখানে এক ব্যক্তি তাকে বেশি বেতনে সৌদিতে যাওয়ার প্রলোভন দেখান। বিনিময়ে ৬০ হাজার টাকা দাবি করেন। ফাহিমা টাকার ব্যবস্থা করতে না পারায় সৌদি যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে ওই ব্যক্তি ফাহিমার অভিভাবক সেজে পাসপোর্ট বানিয়ে বিনা খরচে গত মে মাসে ফাহিমাকে সৌদিতে পাচার করে দেন। সেখানে গিয়ে ফাহিমা বুঝতে পারেন তাকে দাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কৌশলে পালিয়ে সৌদি পুলিশের আশ্রয় নেন। সৌদি পুলিশের একজন তাকে তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ দেন। জানতে পেরে ফাহিমাকে কিনে নেওয়া সৌদি কফিল ওই পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ি থেকে তাকে ফের নিয়ে আসেন। পরে ফাহিমা মোবাইল ফোনে তার পরিবারের মাধ্যমে সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর সিআইডি কর্মকর্তাদের সহায়তায় ওই নারী ২৬ জুন দেশে ফিরে আসেন। ফাহিমার মতো আরও ছয় নারীর খোঁজ পাওয়া গেছে সৌদির রিয়াদে।
সিআইডি কর্মকর্তারা ২০ জুলাই থেকে গ্রিন এক্সিলেন্ট ড্রিম ওভারসিজে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে কিছু নথি ও রেজিস্টার খাতা জব্দ করেন। খাতাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেন ৪-৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ২৫-৩০ বছর বয়সী নারীদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা দালালের মাধ্যমে চক্রটি এসব নারীকে সংগ্রহ করত। তবে চক্রটির দালালরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়।
সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সিরিয়াস ক্রাইম) এ কে এম আক্তারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এক বছরে এ চক্রটি এক শর বেশি নারীকে সৌদি আরবে পাচার করেছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন। চক্রটি বলে বেড়াত তারা গৃহকর্মীর চাকরি দিয়ে পাঠাচ্ছে ওই দেশে। কিন্তু যেসব চুক্তি করত সেসব নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় টাকার বিনিময়ে দাসী হিসেবে বিক্রি করে দিত তারা। জানা গেছে, মার্চে একই চক্র শিউলি নামে এক নারীকে ফুসলিয়ে সৌদি আরবে পাঠায়। শিউলি সৌদি আরবে নারীরা নানাভাবে হয়রানি হচ্ছে এমন খবর শোনার পর যেতে রাজি ছিলেন না। এর পরও চক্রটি তার আত্মীয়স্বজনদের না জানিয়ে তাকে বিদেশে পাঠায়। পাচারের শিকার শিউলি সৌদি আরবে যাওয়ার পর মালিক তাকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করে। বাধা দেওয়ায় তার ওপর চালাত নির্যাতন। এভাবে পাচার হওয়া যে ছয়জনের খোঁজ রিয়াদে পাওয়া গেছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে সিআইডি। এরা মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের অধিবাসী।