কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছে না জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার। গত ৬ বছরে ১৩ টি বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৮ শ্রমিক এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কমপক্ষে ৩৭ জন। এসব ঘটনায় তেমন কোনো শাস্তি হয়নি বলে দুর্ঘটনা রোধেও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলেও রহস্যজনক কারণে উপযুক্ত বিচারের মুখোমুখি হতে হয়না এই কারখানার দায়িত্বপ্রাপ্তদের।
এই বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল আব্দুল্লাহ আল সাকিব বলেন, বৃহস্পতিবার সর্বশেষ দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে মালিকপক্ষের গাফিলতি ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ মিলেছে। আগের দুর্ঘটনাগুলোতেও শ্রম আইনের সাতটি ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। শিগগির এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব দুর্ঘটনার কারণ ও শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখতে গত শুক্রবার কারখানার রিসাইক্লিং পয়েন্ট পরিদর্শন করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল আব্দুল্লাহ আল সাকিব। সেময় তিনি বলেছিলেন জিপিএই ইস্পাত কারখানার দুর্ঘটনাগুলোতেও শ্রম আইনের সাতটি ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কারখানাটিতে লাইসেন্সবিহীন ঠিকাদার কর্তৃক শ্রমিক সরবরাহ, কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও ছবিসহ পরিচয়পত্র সরবরাহ না করা, কারখানায় লিফট, স্কেল, স্ক্যাভেটর ক্রেন অদক্ষ চালক দিয়ে পরিচালনা করা, মেশিনগুলো বছরে কমপক্ষে একবার পরীক্ষার কথা থাকলেও সেটা না করা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বিধি মোতাবেক সেফটি কমিটি গঠন ও কার্যকর না করা।
এ ছাড়া বিপজ্জনক কাজে কর্মরত শ্রমিকদের দুই ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। শিগগির এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন কল-কারখানা অধিদপ্তরের ডেপুটি ইন্সপেক্টর।
জানা যায় জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার ভেতরে পরিত্যক্ত মালামাল কাটার সময় ২৭ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার দুপুরে বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই রঞ্জন দাশ নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয় । নিহত রঞ্জন কুমিরা জেলেপাড়া এলাকার শ্রীমাদ দাশের ছেলে।
এছাড়া ২০২১ সালে এই কারখানায় ৫টি দুর্ঘটনায় দগ্ধ হন ১৭ শ্রমিক। আগের বছরের আগস্টে পুড়ে মারা যান দুই শ্রমিক। তারা হলেন মোহাম্মদ রশিদ ও মো. মন্তাজ। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বরে লোহা গলানোর সময় দগ্ধ হন সাত শ্রমিক। ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর এই কারখানায় দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ৩ শ্রমিক। তারা হলেন মফিজুর রহমান, আবু সাঈদ ও শিমুল দাশ।
এছাড়া, ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় ঘটে আরও দুটি দুর্ঘটনা। ওই দিন সকালে উত্তপ্ত লোহায় দগ্ধ হয়ে নিহত হন কারখানার শ্রমিক পীযূষ দে ও শফিউল বাশার। রাতে আরেক দুর্ঘটনায় আহত হন আরও দুইজন। এর আগে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট ফার্নেস চুলার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে কারখানার সুপারভাইজারসহ সাতজন শ্রমিক গুরুতর আহত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শ্রমিকেরা জানান এখানকার শ্রমিকরা কখনও লোহার উত্তপ্ত লাভায়, কখনও তরল লোহার ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ ঘটে, কখনো লোহার পাত পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অনেক শ্রমিক আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। একের পর এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলেও এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারও। কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ ও কারখানা অধিদপ্তর নেয়নি কোনো ব্যবস্থা। শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় সীতাকুন্ড থানায় সাধারণ ডায়েরি করে দায় সেরেছে পুলিশ।
এব্যপারে চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন একটি কারখানায় এত দুর্ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এই বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত অবহেলার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। আর যেসব ত্রুটি বিদ্যমান তা দ্রুত সমাধান করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সীতাকুন্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার জানামতে জিপিএইচ ইস্পাত কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই কাজ করছে। তবুও গত বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনায় যেহেতু মামলা হয়েছে, বিষয়টির গভীরে গিয়ে তদন্ত করে দেখা হবে।
এ বিষয়ে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) আলমাস শিমুল বলেন, আপনার তথ্য ভুল আছে গত ১৪ বছরে আমাদের এখানে ৬ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘঠেছে। আমাদের কাছে ভিডিওসহ তথ্য প্রমাণ সংরক্ষণে আছে নিউজ করতে হলে আপনি আমাদেও মিডিয়া এডভাইজার অভিক ওসমান সাহেবের সাথে কথা বলে করেন।
এ ব্যাপারে কথা বলতে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের মিডিয়া এডভাইজার মো. অভিক ওসমান কারখানার কিছু অনিয়ম ও অবহেলা থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের কিছু ত্রুটি আছে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কারখানা পরিদর্শন। কিছু পত্রিকায় নিউজ হয়েছে আপনিও করেন। আমি একটু হাসপাতালে আছি পরে ফোন দিয়েন কথা বলব বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।