কক্সবাজারের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো মাসিক চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাট কর্মকর্তাদের ঘুস দেয়। এমনকি ভ্যাট ফাঁকি দিতে কর্মকর্তাদের পরামর্শে বিক্রির একাধিক রেজিস্ট্রার রাখা হয়।
একটি ভ্যাট অফিসের জন্য, অন্যটি মালিকপক্ষের জন্য। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর অনুসন্ধানে এ দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, এখানে মালিকরা ভ্যাট ফাঁকি দিতে একাধিক রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করেন বলে দুদক থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই। আর ভ্যাট কর্মকর্তাদের মাসোহারা দেন কিনা তাও বলতে পারব না। কারণ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসা করেন। রাজস্ব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হওয়ায় এ নিয়ে আর মন্তব্য করতে চাই না।
গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম কার্যালয়কে কক্সবাজারের হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্টে ভ্যাট ফাঁকির বিষয় অনুসন্ধানে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত দল ৭টি হোটেলে অভিযান চালিয়ে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পায়। এর ভিত্তিতে ২৩ মার্চ প্রধান কার্যালয়ে এনফোর্সমেন্ট প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের ডায়মন্ড রেস্টুরেন্ট, জাফরান রেস্টুরেন্ট, অস্টার ইকো, ইউনি রিসোর্ট হোটেল, উইন্ডে টেরিন, আইলেন্ডিয়া ও হোটেল সি উত্তরা ভ্যাট পরিশোধ করছে না। কোনো হোটেলই অতিথিদের এন্ট্রি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করে না এবং রুম ভাড়ার তালিকা নেই। এছাড়া রেস্টুরেন্টগুলো ভ্যাট ফরমও ব্যবহার করে না। মাস শেষে তারা ভ্যাট কর্মকর্তাদের মাসিক রেটে নির্দিষ্ট ভ্যাট পরিশোধ করে থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কর্মকর্তারা হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে মাসিক অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সুবিধার্থে প্রায় হোটেল দুটি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করে। একটি রেজিস্ট্রার ভ্যাট কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততায় প্রকৃত আয় প্রদর্শন না করে সংরক্ষণ করা হয়। আরেকটি লুকায়িত অবস্থায় হোটেল-মোটেল ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের জন্য নির্ধারিত থাকে। কক্সবাজারের অন্য হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোরও একই অবস্থা। এতে সরকার প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুটি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যে ভ্যাট ফাঁকি দেন, এটা সবারই জানা। দুদকের তদন্তে সেটি আবার প্রমাণিত হলো। তবে দুদকের প্রতিবেদনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরও বিস্তারিত তুলে ধরা উচিত ছিল।
যেমন কত মাসোহারা নেন, কীভাবে নেন, তাদের সম্পদের তথ্য তুলে ধরা হলে প্রতিবেদনটি আরও সমৃদ্ধ হতো। দুদকের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করা গেলে এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে কক্সবাজার কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ডিভিশনের বিভাগীয় কর্মকর্তা উপকমিশনার সৈয়দুল আলম বলেন, এক বছর আগে কক্সবাজারে ভ্যাট আদায়ে কী ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে আমি বলতে পারব না। আমি যোগদানের পর ভ্যাট আদায় বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যেখানে ১৬৯ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছে, সেখানে গত অর্থবছরে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর ৪০০ কোটি টাকার লক্ষ্য আদায়ে কাজ করছে ভ্যাট বিভাগ। জানুয়ারিতে চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার পরও আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারব বলে আশা করছি।
তিনি আরও বলেন, মাসোহারা ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে তা ভিত্তিহীন। এখন অনলাইনে রিটার্ন জমা নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা ঘরে বসেই রিটার্ন জমা দিতে পারেন। ভ্যাট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে দুটি ভ্যাট মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করতে হোটেল রেস্টুরেন্টে ১০২টি ইএফডি মেশিন বসানো হয়েছে। চলতি মাসেই আরও ১০০ মেশিন বসানো হবে।