চলতি একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বিএনপিদলীয় সাত সংসদ-সদস্য। তবে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে সশরীরে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন দলটির পাঁচ সংসদ-সদস্য।
এ কারণে প্রথমে পাঁচজনের পদত্যাগপত্র এবং পরে যাচাই-বাছাই শেষে আরও একজনের পদত্যাগপত্র সংবিধান অনুযায়ী গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাকি একজন সশরীরে উপস্থিত থেকে পদত্যাগপত্র না দেওয়ায় এ বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য হারুনুর রশীদ পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন ই-মেইলে।
তার সইটি স্ক্যান করা বিধায় এটি গ্রহণ করা হবে না। তিনি পদত্যাগ করতে চাইলে নতুন করে তাকে আবার পদত্যাগপত্র দিতে হবে।
এদিকে বিএনপির দলীয় সংসদ-সদস্যরা পদত্যাগ করায় একাদশ জাতীয় সংসদের ছয়টি আসন শূন্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সংসদ সচিবালয়। রোববার রাতে পৃথক ছয়টি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
সংসদ সচিবালয়ের সচিব কেএম আব্দুস সালাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘১১ ডিসেম্বর সকালে তারা পদত্যাগ করায় এসব আসন শূন্য হয়েছে।’
পদত্যাগী বিএনপির সাত সংসদ-সদস্য হলেন-উকিল আব্দুস সাত্তার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২), হারুনুর রশীদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), জিএম সিরাজ (বগুড়া-৭), আমিনুল ইসলাম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২), জাহিদুর রহমান (ঠাকুরগাঁও-৩), মোশাররফ হোসেন (বগুড়া-৪) এবং ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা (সংরক্ষিত নারী আসন)।
এদের মধ্যে উকিল আব্দুস সাত্তার অসুস্থ। আর হারুনুর রশীদ বিদেশে রয়েছেন। তারা পদত্যাগপত্র স্বাক্ষর করে পাঠিয়েছেন বলে জানানো হয়। অন্যরা সশরীরে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
উকিল আব্দুস সাত্তারের পদত্যাগপত্রটি যাচাই-বাছাই শেষে তার আসনটিও শূন্য ঘোষণা করা হয়। আর হারুনুর রশীদের পদত্যাগপত্রে দেওয়া সইটি স্ক্যান করা বিধায় এটি গ্রহণ করা হয়নি।
এরআগে রোববার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনে স্পিকারের দপ্তরে যান বিএনপির পাঁচ সংসদ-সদস্য। তারা পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গণমাধ্যমকর্মীদের স্পিকার বলেন, বিএনপির সদস্যরা নিজ নিজ স্বাক্ষরযুক্ত সাতজনের পদত্যাগের আবেদন জমা দিয়েছেন।
পাঁচজন সশরীরে ছিলেন, তাদেরটা গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের ৬৭(২) অনুযায়ী ওই আসনগুলো শূন্য হয়ে গেছে। বাকি দুজনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
স্পিকার জানান, এর মধ্যে উকিল আব্দুস সাত্তার অসুস্থ থাকায় সংসদ সচিবালয় তার স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখবে ও তার সঙ্গে কথা বলবে। সব ঠিক থাকলে তার আবেদনও গ্রহণ করা হবে।
তবে ই-মেইলের মাধ্যমে দেওয়ায় হারুনুর রশীদের আবেদন গ্রহণ করা হবে না, তাকে পরে এসে জমা দিতে হবে। তিনি বলেন, আসন শূন্য হওয়ার গেজেট প্রকাশের পর তাদের কাছে পাঠানো হবে।
পাশাপাশি এটি নির্বাচন কমিশনেও পাঠানো হবে। আসন শূন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন হবে জানিয়ে স্পিকার বলেন, আসন শূন্যের এখন গেজেট হবে। পরে অধিবেশন যখন বসবে সেখানেও জানানো হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, উকিল আব্দুস সাত্তার অসুস্থ থাকায় তার সঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে পদত্যাগের বিষয়ে নিশ্চিত হয় এবং তার স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখা হয়।
এ কারণে পরে উকিল আব্দুস সাত্তারের পদত্যাগের আবেদনটিও সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়।
সংসদ-সদস্যের পদত্যাগের বিষয়ে সংবিধানের ৬৭(২) বলা হয়েছে, ‘কোনো সংসদ-সদস্য স্পিকারের কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন এবং স্পিকার কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার-যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতেও সংসদ-সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধির ১৭৭(১) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘সংসদের আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক কোনো সদস্য এই মর্মে স্পিকারকে সম্বোধন করিয়া স্বহস্তে লিখিতভাবে জ্ঞাপন করিবেন যে, তিনি তাঁহার আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক এবং তিনি পদত্যাগের জন্য কোনো কারণ দর্শাইবেন না; তবে শর্ত থাকে যে, কোনো সদস্য যদি কোনো কারণ জ্ঞাপন করেন, অথবা অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ে অবতারণা করেন, তাহা হইলে স্পিকার স্বীয় বিবেচনামতে অনুরূপ শব্দ বা বাক্যাংশকে বাদ দিতে পারিবেন এবং উহা সংসদে পাঠ করিয়া শোনানো হইবে না।’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে অংশ নিয়েছিল।
সেই নির্বাচনে বিএনপির ছয়জন বিজয়ী হন, পরে সংরক্ষিত নারী আসনের একটি পায় দলটি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে শুরুতে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা সংসদে যাবে না, শপথও নেবে না।
পরে সিদ্ধান্ত বদলে শপথ নেন দলটির সংসদ-সদস্যরা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জয়ী হয়েও নির্ধারিত সময়ে শপথ না নিলে বগুড়া-৬ আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। পরে সে আসনে জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী জিএম সিরাজ।
এর আগে শনিবার রাজধানী ঢাকার গোলাপবাগে বহুল আলোচিত গণসমাবেশ থেকে বিএনপির সংসদ-সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
এর পরপরই রোববার স্পিকারের দপ্তরে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন দলটির পাঁচ সংসদ-সদস্য।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সাংবাদিকদের বলেন, তারা শনিবারই ই-মেইলে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। আজ (রোববার) সশরীরে জমা দিতে এসেছেন।
বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচন : বিএনপির সংসদ-সদস্যদের পদত্যাগজনিত কারণে শূন্য হওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে এসব আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সংবিধানের ১৭৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সদস্যের আসন শূন্য হলে সংসদ সচিবালয়ের সচিব তার গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করবেন। যাতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) শূন্য পদটি পূরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
বিএনপির সদস্যদের পদত্যাগে আসন শূন্য হলে উপনির্বাচন প্রয়োজন পড়বে কিনা-জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিনের আগে কোনো সংসদীয় আসন শূন্য হলে উপনির্বাচন করতে হবে। চলতি একাদশ সংসদের মেয়াদ এখনো এক বছরের বেশি রয়েছে। কাজেই এখন কোনো আসন শূন্য হলে নির্বাচন কমিশনকে আইন অনুযায়ী উপনির্বাচন করতেই হবে।
সংসদ থেকে পদত্যাগের যত ঘটনা : এ দেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সংসদ থেকে পদত্যাগের বিষয়টি নতুন নয়। সংবিধান, কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হলে সংসদ-সদস্যকে নিজ হাতে স্বাক্ষর করা পদত্যাগপত্র জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে জমা দিতে হয়।
রোববার বিএনপি দলীয় সদস্যদের একযোগে পদত্যাগের আগেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-উভয় দলই বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নজির স্থাপন করেছে।
এর বাইরে ব্যক্তিগভাবেও অনেকে সংসদ-সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেও সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। তখন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও মো. আতাউল গনি ওসমানী পদত্যাগ করেন। বিধি মেনে করায় তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় তখন সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় দল ও সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এবং মাহী বি. চৌধুরী।
এছাড়া ২০১২ সালে সংসদ-সদস্য তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পদত্যাগপত্র পাঠালে তা গ্রহণ করা নিয়ে এর বিধিবিধান আলোচনায় আসে।
ওই বছরের ২৩ এপ্রিল সোমবার সকালে সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র সংসদ ভবনে স্পিকারের কার্যালয়ে জমা দেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আবু কাওসার।
কিন্তু তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ প্রথমে তা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানান। তিনি ওই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র সংবিধান ও কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী দেওয়া হয়নি। চিঠিতে কোনো তারিখ ছিল না। আমার অফিসে যেটি এসেছে সেখানে তারিখ লেখা। স্বভাবতই বোঝা যায়, তারিখ অন্য কেউ লিখেছে। একজনের স্বাক্ষর থাকলে সেখানে অন্য কেউ তারিখ লিখতে পারে না। এছাড়া স্বাক্ষর ও তারিখ দুই ব্যক্তির আলাদা কালিতে লেখা বলে মনে হয়েছে।’
ওই সময় স্পিকারের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, পঞ্চম সংসদে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর কাছে বিরোধী দলের ১৪৬ জন সদস্য একযোগে পদত্যাগপত্র জমা দিলে তা তিনি গ্রহণ করেননি। পত্রবাহকের মাধ্যমে দেওয়ার কারণেই এটি করা হয়েছিল।
২০১২ সালের ৭ জুলাই দীর্ঘদিন ধরে চলা সোহেল তাজের পদত্যাগ সমস্যার অবসান হয়। তিনি (সোহেল তাজ) ওই দিন তার পদত্যাগপত্রটি নিজেই স্পিকার আবদুল হামিদের কাছে জমা দেন এবং তা গ্রহণ করা হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ থেকে আরেকটি পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। ওই দিন পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সংসদ-সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং নিজের আরদালির মাধ্যমে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।