বিদেশি অনুদান সংকটের কারণে বাংলাদেশে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থা যেগুলো এনজিও নামে পরিচিত সেগুলোর জন্য কঠিন অবস্থা আসছে। এ জন্য এসব সংস্থাকে টিকে থাকতে হলে পরিবর্তন আনাটা জরুরী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় বেসরকারি সংস্থাগুলো নতুন করে আবিষ্কার ও নতুন লক্ষ্য নিয়ে কাজ না করলে টিকে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এর আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এসব সংস্থার ভূমিকা কম নয়। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পর দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের মাথাপিছু আয় ২৭০০ ডলারের বেশি।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিদেশি দাতা সংস্থা বা অন্য দেশের অনুদান এখন বাংলাদেশের জন্য কমে যাবে নানাবিধ কারণে। একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, অনেক দেশ রয়েছে যেখানে শরণার্থী বেড়েছে কিংবা নিজ দেশের মধ্যেই অনুদানের চাহিদা বেড়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশে কাজ করা সংস্থাগুলোতে আন্তর্জাতিক অনুদান হ্রাস পাবে।
এ বিষয়টি মাথায় রেখে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী দিনে এসব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনাকে অব্যাহত রাখতে হবে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থেই।
যে ধরনের পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশে মূলত স্বাধীনতার পর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের সাথে সাথে এসব সংস্থাগুলোর অনেকে হারিয়ে গেছে, আবার অনেকে বেশ ভালভাবেই টিকে গেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা যারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বাংলাদেশে ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সংস্থাটির কার্যক্রম রয়েছে সেটি হচ্ছে ব্র্যাক।
সত্তরের দশকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্প্রতি এই বেসরকারি সংস্থাটি তাদের ৫০ বছর পার করেছে। এই সংস্থাটিও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে নানা ধরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে গেছে। শুরুতে সংস্থাটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে এটি নানা ভাবে নিজেদের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়েছে।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, যে দশকে যে সমস্যা একটা ব্যাপক আকার ছিল সেই সমস্যা সমাধানে মডেল উন্নয়ন করে সে অনুসারে কাজ করেছে ব্র্যাক।
এক সময়ে দারিদ্র বিমোচনের বিভিন্ন দিক যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, ক্ষুদ্র ঋণের মতো নানা দিক নিয়ে কাজ করলেও পরবর্তীতে এসে সংস্থাটি সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ শুরু করে। সালেহ বলেন, ‘এই পরিবর্তনগুলো সবসময়ই হয়েছে এবং ব্র্যাকের মূল লক্ষ্যই এটা যে পরিবর্তনের সাথে খাপ-খাইয়ে চলতে হবে।’
বাংলাদেশের আরেকটি পুরনো বেসরকারি সংস্থা ঠ্যাঙ্গামারা সমবায় সমিতি বা টিএমএসএস। এই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হোসনেয়ারা বেগম বলেন, আগে যেমন অনেক বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও গণশিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করেছে, সেগুলো এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। এসব প্রকল্পে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ আগ্রহী হয় না, তেমনি দেশ বা দেশের বাইরে থেকে অর্থায়নও এখন আর এ ধরনের গৎ বাঁধা প্রকল্পে আসে না। আগে দারিদ্র বিমোচনে মানুষকে ছোট আকারে পুঁজি দেয়ার জন্য বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো সরাসরি তহবিল দিলেও বর্তমানে তা একেবারেই বন্ধ রয়েছে।
এর চেয়ে বরং মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা রয়েছে এবং তাদের দক্ষতা উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিয়ে মানুষের আগ্রহ রয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের বিষয়ে দেশে ও দেশের বাইরেও চাহিদা রয়েছে। টিএমএসএস বর্তমানে এ ধরনের কাজগুলোর দিকে ঝুঁকছে বলেও জানান তিনি।
আগামীতে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে? নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল হিসেবেই বেসরকারি সংস্থাগুলোকে নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা ও নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করেন অনেকেই। কারণ অনুদান কমে যাওয়ার কারণে যেসব বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও বিদেশি অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা বেশ সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, অর্থায়ন বাংলাদেশে না এসে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে এবং মানবিক নানান সমস্যা যেসব স্থানে বাড়ছে সেখানে বিদেশি অর্থায়ন যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে শরণার্থী সমস্যা, জলবায়ু সমস্যা বা ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ ইত্যাদি। এছাড়া আন্তর্জাতিক সহায়তার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ভেতরেও এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেছে। এর ফলে যেসব এনজিও পুরোপুরি দাতা দেশের ওপর নির্ভরশীল তাদের জন্য বিপদ বাড়ছে। এ কারণে যারা নিজেদের অর্থ সংস্থানের উপায় বের করতে পেরেছে এরই মধ্যে তারা কিছুটা ভালো অবস্থানে আছেন। কিন্তু যারা প্রকল্প ভিত্তিক কাজ করেছে তাদের অবস্থা খারাপ এবং অনেকগুলো বন্ধও হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে টিএমএস এর নির্বাহী পরিচালক হোসনেয়ারা বেগম বলেন, ‘তাদের সামনে তো বিরাট চ্যালেঞ্জ এখন। তাদের অপারেশনাল কস্ট, এর জন্য যে ফাইনান্সিয়াল সাপোর্ট দরকার সেটা যেহেতু ডোনারদের কাছ থেকে পাচ্ছে না, সরকারও যদি না। এ ক্ষেত্রে তাদের ডাইমেনশন, তাদের একটা প্যারাডাইম শিফট চেঞ্জ হবে এবং এটা করতেই হবে।’
কীভাবে খাপ খাওয়াবে? অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাজ অবশ্যই অব্যাহত থাকতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র বিমোচন, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন। এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে সরকারের একার পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। ভট্টাচার্য বলেন, শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এসব ক্ষেত্রে সরকারের একার পক্ষে সাফল্য পাওয়া দুষ্কর। বরং এখানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে হবে। এসব সংস্থার ভূমিকা এখানে অনেক বেশি দরকার। তাই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কর-রেয়াত দেয়ার মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও নানান সুবিধা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, এনজিওগুলোকে আরও বেশি সংস্কার করা, নতুন আবিষ্কার নিয়ে কাজ করা, নতুন জায়গা নিয়ে আগের তুলনায় ভিন্নভাবে কাজ করতে হবে। কারণ আগে যে দাতারা তহবিল নিয়ে আসতো প্রকল্পে কাজ করার জন্য সেই মডেল এখন একেবারেই অচল।
সালেহ বলেন, বাংলাদেশে এখনো নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করার অনেক জায়গা আছে। নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। এই জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। এছাড়া বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এখনো ‘পোভার্টি পকেট’ বা দরিদ্রতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তারা বাংলাদেশের অগ্রগতির ট্রেন মিস করেছে উল্লেখ করে সালেহ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব জায়গা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভূক্তভোগী বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল, হাওর অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় এলাকায় এখনো অঞ্চলভেদে দারিদ্র নিরসনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ-খাওয়ানোর বিভিন্ন উপায়, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সংক্রামক নয় এমন রোগ, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতগুলো নিয়ে কাজের সুযোগ রয়েছে।
টিএমএসএস এর নির্বাহী পরিচালক মিজ বেগম মনে করেন, বেসরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে বিধায়, বিদেশি অর্থায়ন না আসলেও যাতে সেগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য না হয় তার জন্য নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা করাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় টিকে থাকতে হলে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসার সাথে জড়িত হতে হবে। এছাড়া এমন সব প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে যার চাহিদা মানুষের মধ্যে রয়েছে। সূত্র: বিবিসি