হামিদ বিশ্বাস
ব্যাংকিং খাতে আদায় অনিশ্চিত হওয়ায় খেলাপি বা কু-ঋণ দ্রুত বাড়ছে। ২০০৯ সালে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বা খারাপ ঋণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার কিছু বেশি।
২০১৮ সালের শেষের দিকে তা ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০ বছরে কু-ঋণ ৬৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা বেড়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে কু-ঋণের পরিমাণ ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের কু-ঋণ ৪০ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বেসরকারি ৪০ ব্যাংকের কু-ঋণ ৩৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বিদেশি ৯ ব্যাংকের কু-ঋণ দুই হাজার ৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং সরকারি বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের কু-ঋণ চার হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ।
একইভাবে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে কু-ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা, যা তখনকার মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের কু-ঋণ ছিল ১০ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বেসরকারি ৩০ ব্যাংকের কু-ঋণ ছিল চার হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
বিদেশি ৯ ব্যাংকের কু-ঋণ ছিল ২২৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং সরকারি বিশেষায়িত ৫ ব্যাংকের কু-ঋণ ছিল ২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। মূলত আদায় অনিশ্চিত খেলাপি ঋণের (কু-ঋণ) কারণে ব্যাংকিং খাতে বিপুল অংকের প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বড় ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল।
পৃথিবীর সব উন্নত রাষ্ট্রে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে শাস্তির নজির রয়েছে। ভারত, নেপাল এমনকি চীনেও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিকে ভিআইপি ট্রেনে চড়তে কিংবা বিমানে উড়তে দেয়া হয় না।
এদিকে আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে নিরাপত্ত সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। সেপ্টেম্বরে ১২টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে।
এ তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- বেসিক ব্যাংকে তিন হাজার ৫৪৮ কোটি, সোনালী ব্যাংকে তিন হাজার ৫৪৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকে এক হাজার ৩৫৩ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৮৬৭ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৪২১ কোটি, এসআইবিএলে ৩৫৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৬১ কোটি, এবি ব্যাংকে ১২৪ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১০২ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকে ৯৭ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ৯৬ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৬২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে ৮ ডিসেম্বর গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) আয়োজনে ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যাংকিং খাতকে যেন রাজনৈতিক নেতারা অনিয়ম ও লুটপাটের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেন।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য এ খ্যাতকে যেন ব্যবহার না করা হয়। আর ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারা যেন অর্থ লুটপাটের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যাংক খাতকে বেছে না নেন।
জাতীয় নির্বাচনে ঋণখেলাপি প্রার্থীদের মনোনয়ন বৈধতা সম্পর্কে ড. মাহমুদ বলেন, প্রভাবশালী প্রার্থীদের ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরনো ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।