তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের নাম আলটিমা ওয়ালেট। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের প্রচলিত সুদহারের চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া যাবে—এমন প্রলোভন দেখিয়েছিলেন রাজশাহীর ব্যবসায়ী আবদুল মতিন। অনেকে এই অ্যাপে বিনিয়োগও করেছিলেন। কেউ কেউ দুই-তিন মাস সুদের টাকাও পেয়েছেন।
এর পর থেকে অ্যাপ বন্ধ। মতিন পালিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। অভিযোগ রয়েছে, শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মতিন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তোলার পর অনেকেই পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মতিনের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। থাকতেন রাজশাহী শহরে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা এখনো দেশেই রয়েছেন। রাজশাহী নিউমার্কেটে এশিয়ান ক্রোকারিজ, লাইফ কেয়ার মেডিকো, এশিয়ান স্কাইশপ প্লাসসহ তাঁর কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিউমার্কেটের দোকানপাট এখন গোপনে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে দুবাইয়ে অবস্থানরত মতিনের হোয়াটসঅ্যাপে দুদিন একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। প্রতারণার অভিযোগে গত ২৬ জুন মতিনসহ আটজনের বিরুদ্ধে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা হয়। এই মামলার পর মতিনের প্রধান সহযোগী মাহবুবুর রহমান ওরফে মোনায়েম, হৃদয়সহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার বাদীর নাম সবুজ আলী (২৩)।
মামলার এজাহারে বলা হয়, নগরীর উপশহরে প্রতারকেরা আলটিমা অ্যাপের অফিস খুলেছিল। প্রলোভনে পড়ে তিনি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। গত ২০ জুন তিনি ওই অফিসে গিয়ে দেখেন, সেটি বন্ধ। এই অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে গেলে আরও ভুক্তভোগীর খোঁজ পাওয়া যায়।
যেভাবে প্রচার
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে রাজশাহীতে আলটিমা ওয়ালেট নিয়ে প্রথম প্রচারণা চালান মতিন। প্রচারের ক্ষেত্রে বড় নাম মোনায়েম। তাঁর বাড়ি রাজশাহী নগরীর ডাঁশমারী পূর্বপাড়া মহল্লায়। চলতি বছরের শুরুর দিকেও মোনায়েম নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন। তিনি এখন বিপুল টাকার মালিক। মোনায়েম দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়ে, নামীদামি হোটেলে থেকে ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করে জানান দিতে থাকেন, আলটিমা অ্যাপে বিনিয়োগ করে তাঁর ভাগ্য খুলে গেছে।
রাজশাহীর আসাম কলোনিতে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে সাততলা একটি বাড়ির নির্মাণকাজও শুরু করেন তিনি। রাতারাতি তাঁর এমন উন্নতি দেখে শত শত যুবক হুমড়ি খেয়ে পড়েন এই অ্যাপে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় গ্রাহকদের নিজ খরচে দুবাই নিয়ে গেছেন মতিন। যাঁরা অ্যাপে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের চেকও দিয়েছেন তিনি। আলটিমা ওয়ালেট অ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে গত জুলাইয়ের দিকে মতিন দুবাই পালিয়ে যান।
নগরীর ডাঁশমারী এলাকার লিটন ইসলাম বলেন, মোনায়েম ও মতিনকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তিনি। প্রতি মাসে ১৪ হাজার টাকা লাভ পাওয়ার কথা ছিল। দুই মাসে পেয়েছেন ২৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা গচ্চা গেছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি মোবাইল নম্বর ও একটি করে ই-মেইল আইডি খুলে দিতেন মতিন ও তাঁর সহযোগীরা। তারপর আলটিমার হিসাবে বিভিন্ন প্যাকেজে বিনিয়োগ করাতেন। মতিন ও মোনায়েমকে টাকা দিলেই গ্রাহকের অ্যাপে দেখাত মার্কিন ডলার। এভাবে কয়েক হাজার বিনিয়োগকারীর ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছেন মতিন।
ভুক্তভোগীদের হয়রানি
ভুক্তভোগী ও পুলিশ সূত্র বলেছে, মতিন টাকা নেওয়ার সময় যে চেক দিয়েছেন, তা নিয়ে অভিযোগ করতে গেলে ভুক্তভোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মতিনের পক্ষে তাঁর ভাই আনোয়ার হোসেন নয়ন ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে চেক চুরির মামলা করছেন। এমন একজন ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী ভুক্তভোগী আনারুল ইসলাম। মতিন তাঁকে দিয়েছিলেন ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক। আনারুল ইসলাম বলেন, মতিন দুবাই পালিয়ে গেলে তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। পরে টাকা আদায়ে মামলা করেন। এরপর মতিনের ভাই নয়ন গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে চেক চুরির মামলা করেন। মতিন আরও যাঁদের চেক দিয়েছেন, তাঁদেরও এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, চেক চুরির মামলায় মতিনের ভাইকে সহযোগিতা করেন বোয়ালিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম ও উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা। বিষয়টি নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানতে পেরেছেন। তাই মামলাটির তদন্তভার নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একজন পরিদর্শককে দেওয়া হয়েছে। এখন আমিরুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফার ব্যাপারেও অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র।
জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া থানার এসআই গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মামলাটি এখন আমার কাছে নাই। ১৫-২০ দিন হলো মামলাটা ডিবিতে হস্তান্তর হয়েছে।’ ভুক্তভোগীদের হয়রানি করার অভিযোগ অস্বীকার করে মতিনের ভাই নয়ন বলেন, ‘আমাদের ১০৮টা চেক চুরি হয়ে গেছে।’ ভাই মতিন আলটিমার মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হাস্যকর।’ দুবাইয়ে আলটিমার অনুষ্ঠানে মতিন থাকার ছবি দেখালে নয়ন বলেন, ‘যে দেশে বৈধ, এটা সেই দেশের ছবি।’ নয়ন দাবি করেন, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মতিন দুবাইয়ে আছেন।
তবে ভুক্তভোগী সবুজ আলীর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বোয়ালিয়া থানার এসআই আশরাফুল ইসলাম বলেন, কোনো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে মতিন দুবাই যাননি। তিনি পালিয়েছেন। পুলিশের যতগুলো টুলস আছে, তার সবই ব্যবহার করে মতিনকে দেশে আনার চেষ্টা চলছে।