আতাউর রহমান ;জনপ্রতিনিধিদের শপথ ও নানা ইস্যুতে মান-অভিমানের কারণে ভাঙনের মুখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোট। ইতিমধ্যে ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে বিএনপির দুই দশকের সঙ্গী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। লেবার পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল জোট ছাড়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। অপর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এমতাবস্থায় ভাঙন ঠেকিয়ে জোটের ঐক্য অটুট রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি।
এরই অংশ হিসেবে আগামীকাল সোমবার ২০-দলীয় জোটের বৈঠক আহ্বান জানানো হয়েছে। ২০ দলের শরিকদের ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য সুদৃঢ় করতেও নেয়া হচ্ছে উদ্যোগ। এসবের মধ্য দিয়ে জোট শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে গত সোমবার ২০ দলের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ হঠাৎ জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলে বিএনপির হাইকমান্ডের টনক নড়ে। পর দিনই ২০ দলের অপর শরিক লেবার পার্টিও ২৩ মের মধ্যে বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আলটিমেটাম দেয়। নতুবা ভিন্ন পথ ধরার হুশিয়ারি দেয় মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন দল। ২০ দলের শরিক আরও কয়েকটি দল বেরিয়ে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়। এসব কারণে ২০ দলের প্রধান শরিক বিএনপির শীর্ষ নেতারা নড়েচড়ে বসেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, ২০-দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখতে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুত কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ২০-দলীয় জোটের উল্লেখযোগ্য শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ শুরু করেন। ফলে জোটের অন্যতম শরিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদ জোটে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি দেন। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমও ২০-দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখার পক্ষে তার অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।
পাশাপাশি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়া বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান টেলিফোনে পার্থের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। তাকে জোটে ফিরে আসা এবং ২০ দলের আগামী বৈঠকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তখন পার্থ জোটে ফিরতে রাজি না হলেও ২০ দলের বৈঠকে যোগ দেয়ার কথা দেন।
এ বিষয়ে ২০-দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আহ্বানে এবং তার নেতৃত্বে যে ২০-দলীয় জোট গঠিত হয়েছে তা অবশ্যই অটুট থাকবে। বর্তমানে জোট নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি মিথ্যা মামলায় সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাগারে আছেন। তাকে মুক্ত করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নিজেদের মান-অভিমান থাকতেই পারে, সেসব ভুলে আমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে গণতন্ত্রের প্রতীক খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে দেশের গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করব। খুব শিগগির খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে জোটের পক্ষ থেকে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
পার্থের জোট ছাড়ার ঘোষণায় হঠাৎ করে ২০-দলীয় জোটে ঝড় শুরু হয়। তবে এ ঝড় ঠেকাতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা কালক্ষেপণ না করে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এর ফলে ইতিমধ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতারা এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জাগপা, লেবার পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে সরাসরি অথবা ফোনে যোগাযোগ করেছেন।
শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনে আগামীকাল সোমবার ২০-দলীয় জোটের বৈঠক ডেকেছে বিএনপি। বিকাল ৪টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এ জোটের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সেটি ছিল জোটের দ্বিতীয় বৈঠক। দীর্ঘদিন ধরে বৈঠক না ডাকায় জোটের বাধন হালকা হয়ে গেছে বলে মনে করেন নেতারা।
সূত্র জানায়, বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বিজেপির জোট ত্যাগ এবং আরেক শরিক লেবার পার্টির বিএনপিকে দেয়া আলটিমেটামসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকে জোট সংস্কারেরও প্রস্তাব তোলা হতে পারে। জোটের আকার কমিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
জোট ত্যাগকারী আন্দালিভ রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকেও বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। শনিবার রাতে গুলশান কার্যালয় থেকে আন্দালিভ রহমান পার্থকে ফোন করে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে পার্থ বৈঠকে যোগ না দেয়ার কথা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্থ বলেন, ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় থেকে ফোন দেয়া হয়েছে। তবে আমি ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করব না।
তবে আজ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খানও পার্থের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিজেপির বৈঠকে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সোমবারের বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্কাইপিতে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত শরিকদের অবহিত করা হবে। একই সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত ভোট ডাকাতির অভিযোগ তোলে একাদশ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করা বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোট একাদশ সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারেনি জোটের শরিক বিএনপি ও গণফোরাম। দুটি দলের নির্বাচিত ৮ প্রতিনিধির মধ্যে সাতজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। জোটের শরিকদের অভিযোগ তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই প্রধান শরিক বিএনপি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে পুনর্নির্বাচন দাবি করার নৈতিকভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে জোটের। এই অভিযোগে সোমবার ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় আন্দালিভ রহমান পার্থের বিজেপি।
এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও ভাঙনের সুরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গণফোরামে ভেঙে আলাদা দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। আবার জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বিএনপির সঙ্গ ত্যাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এসব দলের নেতাদের অভিযোগ, জোটসঙ্গী হলেও বিএনপি তাদের না জানিয়ে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকট দানা বেধেছে বিএনপিতে।
‘অসঙ্গতি’ দূর করার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন ফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অসঙ্গতি ও কিছু প্রশ্নের উত্তর আগামী এক মাসের মধ্যে সুরাহা না হলে ৮ জুন ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
দুদিন আগে দলের বর্ধিতসভায় ঐক্যফ্রন্টে বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে উঠতে এক মাসের আলটিমেটাম দেয়ার পর শনিবার ফ্রন্টের শরিকদের আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন কাদের সিদ্দিকী।
চিঠিতে বলা হয়, ‘জনগণের মনে আপনার (ড. কামাল হোসেন) নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে যেসব প্রশ্ন জেগেছে, তার যথাযথ প্রতিকার ও প্রতিবিধান কামনা করছি। তা না হলে আগামী ৯ জুন অথবা পরবর্তী দু’একদিনের মধ্যে প্রয়োজনে আরও ব্যাপক আকারে বৈঠক করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হব’।
নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোয় ব্যর্থ, প্রহসনের নির্বাচনী নাটক প্রত্যাখ্যান পরবর্তী সময়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদের এবং এর পরে গণফোরামের মোকাব্বির খানের শপথগ্রহণ, তাকে গেটআউট বলে বের করে দেয়া, পরবর্তীতে তাকে আবার দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সামনের সারিতে বসানো নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাটে জবাব দেয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, শপথ ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে চলছে মনকষাকষি। শরিকদের না জানিয়ে বিএনপির ৫ সদস্য শপথ নেয়ার বিষয়টি মানতে পারছে না দলগুলো।আ স ম আবদুর রবের জাসদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যও এ বিষয়ে নাখোশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি শপথের বিষয়ে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ আমাদের কিছুই বলেনি। অন্তত একটা বৈঠক সঙ্গে সঙ্গে ডাকা দরকার ছিল। সেখানে তারা জানাতে পারত যে বিশেষ অবস্থায় শপথের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিস্তারিত ব্যাখ্যা পরে দেব। কিন্তু তারা কিছুই করেননি। বিএনপিকে এখন খোলাসা করতে হবে যে এই কারণে আমরা শপথ নিয়েছি, যাতে তাদের কথা শুনে অন্যদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়। একই অবস্থা গণফোরামের ক্ষেত্রেও। তারাও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে পথ চলতে হলে বিষয়টি শরিকদের জানাবেন বলে আশা করি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, যে পদ্ধতিতে বিএনপি সংসদে গেছে, সেভাবে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটি এবং শরিকদের জানিয়েই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। ফলে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শরিক কয়েকটি দলের অভ্যন্তরে বিরোধ বা অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপির হাইকমান্ডের উচিত দল এবং জোটের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব দ্রুত ঘুচিয়ে ফেলা। এ লক্ষ্যে শিগগির তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি খোলাসা করা উচিত।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শেষ মুহূর্তে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্তে দল এবং জোটের শরিকদের কেউ কেউ কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। কেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি সেই প্রশ্নও তুলছেন। কোন পরিস্থিতিতে কেন শপথের সিদ্ধান্ত সেই বিষয়ে দলীয় নেতা ও জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করব। দ্রুত তাদের সঙ্গে বৈঠকের চিন্তাভাবনা রয়েছে। এ ইস্যুতে যাতে দল ও জোটের মধ্যে কোনো বিভেদ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি না হয়, সেদিকে আমরা সতর্ক আছি।