শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের স্বপ্ননীড় হাউজিং এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বক্করের বাসায় ঢোকে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরা ২৫ থেকে ৩০ জন। ঢুকেই তারা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ভয় দেখাতে থাকে, বক্করকে অস্ত্রের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে থাকে কয়েকজন। কেউ আবার লোহার রড, শাবল ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে জিনিসপত্র ভেঙে বাসায় লুটপাট শুরু করে। হাতিয়ে নেয় নগদ ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার। বক্করের প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে এলে লুটপাটে জড়িতরা বলতে থাকে– ‘এখানে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান চলছে।’ সবাইকে দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় তারা।
নাটকীয়ভাবে দুর্ধর্ষ এই ডাকাতির ঘটনায় গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জনই সেনা, বিমান, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। যাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি, তাদের প্রকৃত নাম-পরিচয় বের করার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। কীভাবে, কবে আর কাদের যুক্ত করে তারা এমন ডাকাত চক্র গড়ে তুলেছে, চলছে সেই অনুসন্ধান। এই চক্রের নেপথ্যে কে বা কারা রয়েছে, তা এখনও বের করা যায়নি।
গ্রেপ্তার ১১ জনের মধ্যে র্যাবের হাতে আটজন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে তিনজন ধরা পড়ে। তাদের কাছ থেকে ডাকাতি হওয়া ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা, দুটি আইফোন ও স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়েছে। ডাকাত দলের সদস্যরা আরও কোনো বাসা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করেছে কিনা– তা জানতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবি যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা হলো– শরীফুল ইসলাম তুষার, জাকির হোসেন ও মাসুদুর রহমান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, মোহাম্মদপুরে ডাকাতিতে জড়িত গ্রুপটির মতো আরও নতুন কোনো চক্র আছে কিনা তার খোঁজ চলছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়। ওই দিন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগে বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তারও হন।
ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন নিয়মিত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকে পুলিশ। এ সুযোগে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করে। তবে পরে থানার কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হতে থাকে।
শুক্রবার গভীর রাতে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে ডাকাত দল ব্যবসায়ী আবু বক্করের বাসায় ঢুকে লুটপাট চালায়। এ ঘটনায় শনিবার মোহাম্মদপুর থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন বক্কর।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ডাকাতির ঘটনায় জড়িত আটজনকে র্যা ব গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। তাদের সংশ্লিষ্ট বাহিনীর কাছে দেওয়া হবে। বাহিনীর আরও কেউ জড়িত কিনা, সে বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বাকি তিনজনকে থানায় সোপর্দ করা হবে। তাদের কাছ থেকে ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, লুট করা ৭ লাখ টাকা, স্বর্ণের একটি ব্রেসলেট ও আংটি উদ্ধার করা হয়েছে। ডাকাত দলে জড়িত অপর সদস্যদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
মুনীম ফেরদৌস বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কেউ কোনো বাসায় অভিযানে গেলে পরিচয় নিশ্চিত হবেন। সন্দেহ হলে কাছের থানায় ফোন করবেন।
ডিবি উত্তরের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ রবিউল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ডিবির হাতে গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজন বিজিবির চাকরিচ্যুত সদস্য। অভিযান অব্যাহত আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া শাখা থেকে এক খুদে বার্তায় বলা হয়েছে, ওই তিনজনের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, প্রায় চার ভরি স্বর্নালংকার ও দুটি আইফোন উদ্ধার করা হয়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান জানান, ঘটনার পরপরই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাতে সেনাবাহিনী ও র্যানবের পোশাক পরে ডাকাত দলকে বাসায় ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে। প্রত্যেকের মুখে মাস্ক পরা ছিল।
ভুক্তভোগী আবু বক্কর ইট-বালু, কয়লা ও জমির ব্যবসা করেন। মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ির ৭২০/১ নম্বর বাড়ির তিন তলায় বাস করেন তিনি।
মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টায় তাঁর বাসার সামনে চারটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকারে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে ২৫ থেকে ৩০ জন অজ্ঞাতপরিচয় লোক আসে। বাড়িটির দারোয়ান জমশেদকে তারা জানায়, আবু বক্করের বাসায় অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাতে এসেছে তারা। বাহিনীর পোশাক ও কটি পরে থাকায় জমশেদ তাদের ১৪-১৫ জনকে নিয়ে তিন তলায় ওঠেন। বাইরে থেকে দরজা ধাক্কাতে থাকে তারা। দরজা খোলার পর ডাকাত দল বাসায় প্রবেশ করে। একজনের কাছে রাইফেল ছিল। অস্ত্র দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। বাসায় অবৈধ অস্ত্র আছে অভিযোগ তুলে তল্লাশি শুরু করে তারা। একই ফ্ল্যাটের এক পাশে আবু বক্করের অফিস।
বাসা ও অফিসের তিনটি স্টিলের আলমারি, একটি ওয়ার্ডরোব, দুটি সিন্দুক ও একটি শোকেস লোহার রড, হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে ভেঙে ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। সেগুলো দুটি বস্তায় ঢুকিয়ে নেয়। এ সময় আবু বক্কর প্রতিবাদের চেষ্টা করলে তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়। ভয়ে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে চুপ হয়ে যায়। খবর পেয়ে পঞ্চম তলা থেকে বক্করের ভাতিজা মো. মোমিন হোসেন ওই বাসায় আসেন এবং ইউনিফর্ম পরিহত লোকজনের আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করেন। এ সময় অস্ত্রের মুখে তাঁকে জিম্মি করে তাঁর মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয় লুটকারীরা। এরই মধ্যে মেয়ে জিন্নাত তাঁর ভাই মো. মিলনকে ফোন করে বিষয়টি জানান। পরে মিলনসহ প্রতিবেশীরা বাসার সামনে আসেন। কিন্তু বাসার নিচে ইউনিফর্ম ও কটি পরা অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৪-১৫ জন অবস্থান করায় মিলন বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। পরে মিলন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে ৪টা ১০ মিনিটে বাসা থেকে দুটি বস্তায় টাকা ও স্বর্ণ লুট করে তারা নিচে নেমে গাড়ি নিয়ে আল্লাহ করিমের মার্কেটের দিকে চলে যায়।
আবু বক্কর সমকালকে বলেন, ইউনিফর্ম পরে থাকায় তারা যে ডাকাত, তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। অবৈধ অস্ত্র থাকার অভিযোগ তুলে তারা বাসায় তল্লাশি শুরু করে। পরে যখন টাকা-স্বর্ণ লুট করে নিয়ে যায়, তখন বুঝতে পারি তারা ডাকাত।