আব্দুল লতিফ রানা; ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগী দালালরা গা-ঢাকা দিয়েছে। ওই প্রতারকচক্রের মধ্যে সাবেক রেকর্ড রুমের হামিদুল, জরুরি বিভাগের পারভেজ, সুমন, সেলিম, বহির্বিভাগের রফিক ও বাবুল অন্যতম। ওই চক্রটি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ঢামেকের ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিল।
র্যাবের অভিযোগ— গ্রেপ্তারকৃত আরিফ আগে বহির্বিভাগে ওয়ার্ডে ডিউটি করার সময় একটি রুম থেকে এই ব্যবসা পরিচালনা করতো। এ চক্রের সদস্যদের ধরতে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
ঢামেকের দুর্নীতিবাজ ডাক্তার-দালাল একাকার হয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কোটি কোটি টাকা হাসাপাতালের ইনজুরি ও ছুটির সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিল। শুধু ঢামেকের সার্টিফিকেটই নয়, সেখান থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের নামিদামি ডাক্তারের নামে সার্টিফিকেট তৈরি করে বিক্রি করা হতো।
ওই সার্টিফিকেট বিক্রির চক্রটি এক গোপন কারখানায় পরিণত হয়েছিল। অথচ ওই সব ডাক্তার বা চিকিৎসক জানতেন না যে, তাদের স্বাক্ষর নকল করে সার্টিফিকেট ব্যবসা চলছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দৈনিক আমার সংবাদ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আর ওই সব প্রতিবেদন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে তার সত্যতা পায়।
অবশেষে সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢামেক হাসপাতালের নার্সিং কলেজের ভেতরের গ্যারেজে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) একটি দল অভিযান চালিয়ে সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীদের অন্যতম নায়কের সন্ধান পায়। এরপর হাসপাতাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. আরিফ (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।
এসময় তার দখল থেকে জাল জন্ম-মৃত্যু সনদপত্র, নকল সিল ও ইনুজরি সনদ, স্ট্যাম্প উদ্ধার করে র্যাব-১০। গ্রেপ্তারকৃত মো. আরিফ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হিসেবে কর্মরত বলে নিশ্চিত করেছে র্যাব।
র্যাব-১০ এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই টাকার বিনিময়ে চক্রটি জাল সনদ তৈরি ও সরবরাহ করতো আরিফ। ঢামেক হাসপাতালের শুধু ওয়ার্ড বয়ই নয়, ওই চক্রে আরও অনেকেই জড়িত। তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢামেকের রেকর্ড রুমের দায়িত্বরত কর্মকর্তার সঙ্গে র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত আরিফের সখ্যতা রয়েছে। ওই কর্মকর্তা জাল সার্টিফিকেট ব্যবসার সহযোগিতা করতেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢামেকের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন।
ওই অভিযানের নেতৃত্বদানকারী র্যাব-১০ এর মেজর মো. জাহাঙ্গীর আলম অভিযানের পর বলেছেন, পুলিশের যেকোনো মামলায় প্রতবেদনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে ইনজুরি সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়। যা নরমালি একটা অফিসিয়াল সিস্টেমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দেয়া হয়।
এ প্রক্রিয়ায় সার্টিফিকেট পেতে সময়সাপেক্ষ। আর এই সুযোগটি নিয়ে দালাল চক্রটি অল্প সময়ের ব্যবধানে জালিয়াতির মাধ্যমে মেডিকেল সনদ, ইনজুরি সনদ সরবরাহ করতো। শুধু তাই নয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরও চক্রটি জাল করতো।
র্যাব কর্মকর্তা বলেছেন, মেডিকেল কলেজের মাধ্যমে যেকোনো প্রয়োজনে মেডিকেল সনদ নিতে গেলে সত্যতা থাকতে হয়, সময়ও লাগে। কিন্তু এই চক্রটি কেউ মারধরের শিকার হয়নি, ইনজুরি হয়নি কিন্তু তার ইনজুরি সনদ দরকার, তাদেরকে জাল ইনজুরি সার্টিফিকেট সরবরাহ করে আসছিল।
আর ওই জাল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতেই অনেকেই প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই ওই জালিয়াতচক্র ব্যবসা করে আসছিল। এ চক্রের সঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের বেশ কয়েকজন কর্মচারী ও ওয়ার্ড মাস্টাররা জড়িত রয়েছেন।
তাদের ব্যাপারে র্যাব, ডিবিসহ গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত মো. আরিফ ঢামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হলেও তার সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত রয়েছে বলেও র্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসছে। তাদের খুব শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে।
এর আগে গত ২০১৮ সালের ২৯ জুন ‘ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে মিথ্যা মামলা’, ‘সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতিবাজ ডাক্তার-দালাল একাকার’ শিরোনামে দৈনিক আমার সংবাদে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তদন্তে নামে। এরপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঢামেক হাসপাতালে সার্টিফিকেট ব্যবসায়ী, কথিত ডাক্তার ও দালালদের ওপর নজরদারি শুরু করে। আর এ জন্য হাসপাতালে সার্টিফিকেট ব্যবসায়ী, প্রস্তুতকারিসহ দালালদের আনাগোনা থেমে যায়।
সূত্র জানায়, ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি দেখিয়ে দালালের মাধ্যমে জাল সার্টিফিকেট নিয়ে মিথ্যা মামলা করেন গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মচারী।
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর মিথ্যা মামলার শিকার ভুক্তভোগী মেডিকেল কলেজ গণপূর্ত বিভাগের উচ্চমান সহকারী নুরুল ইসলামের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠে।
এরপর গত বছর ১৫ জুলাই ওই মামলার বাদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি জোনের তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আহসান খান তার কার্যালয়ে নোটিসের মাধ্যমে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
সূত্র আরো জানায়, ওই মামলার তদন্তে উল্লিখিত মেডিকেলের ইনজুরি সার্টিফিকেটটি ভুয়া হিসেবে তদন্তে প্রমাণ পায় তদন্তকারী কর্মকর্তা। আর ওই সার্টিফিকেটে যে ডাক্তারের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয় তাও ভুয়া। শুধু তাই নয়, ওই সময় যে ডাক্তার ছিলেন না, সেই ডাক্তারের স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছিল।
অন্য এক সূত্র জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রতি বছর গড়ে দুই থেকে আড়াইশ ভুয়া সার্টিফিকেট তদন্তের জন্য পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থা হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে থাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনায় জড়িত চিকিৎসকদের চাকরিচ্যুত ও বদলিসহ যথাযথ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকেন।
অপরদিকে দুর্নীতিবাজ কতিপয় চিকিৎসক ও দালালের মাধ্যমে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে মিথ্যা মামলায় শত শত ব্যক্তি জেল-জুলুমসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
উল্লেখ্য, মেডিকেল কলেজ গণপূর্ত বিভাগ সেগুনবাগিচা, ঢাকার, উচ্চমান সহকারী নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেটে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হন। ওই মিথ্যা মামলার বাদি আব্দুর রাজ্জাক।তিনি সরকারি কর্মচারী। ওই মিথ্যা মামলার আসামি গণপূর্ত বিভাগে নুরুল ইসলাম। তার এক আত্মীয়কে চাকরির নামে ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়।
কিন্তু মামলার বাদি চাকরি দিতে না পারায় নুরুল হক টাকা ফেরত চান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধে কথাকাটাকাটি হয়। এ ঘটনার পর এক মামলায় ঢামেকের ৭৭৮৭৮৫-নম্বর রেজিস্ট্রারে গত ৪ মার্চ ২০১৮ চিকিৎসা নেন। তার এক মাস আগের ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ইনজুরি সার্টিফিকেট মামলায় নথিভুক্ত করা হয়।
শুধু তাই নয়, ওই রেজিস্ট্রেশনের ঢামেক হাসপাতালে যে রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তার নাম মুন্না (৪০) ছিলো। অথচ একই রেজিস্ট্রেশনে বাদি মেডিকেল সার্টিফিকেট চিকিৎসক দিয়েছেন ডা. মোহাম্মদ মোমিনুল হক।
কিন্তু ওই সময়ে ঢামেক হাসপাতালে ডা. মোহাম্মদ মোমিনুল হক নামে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। আর মামলায় বাদির বয়স (৫৫) উল্লেখ করা হয়, অথচ হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে ওই রোগীর বয়স ৪০ লেখা রয়েছে।
ঢামেকে জাল সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযানের নেতৃত্বদানকারী অভিযানের পর বলেছেন, র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত মো. আরিফ ঢামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হলেও তার সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত রয়েছে। তাদেরকে খুব শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে।