পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স শুরু হয় ২০০২ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ প্রথম এ কোর্স চালু করে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পথে হাঁটতে থাকে। বর্তমানে দেশের ২০টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন নামে সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের আয়েরও বড় উৎস সন্ধ্যাকালীন এসব কোর্স। তবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সান্ধ্য কোর্সের তীব্র সমালোচনা করার পর তা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
গতকালই নির্দেশনাসংবলিত চিঠি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বিধায় এসব কোর্স বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এ নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ইউজিসি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম বন্ধেও কাজ করে। এর অংশ হিসেবেই এ চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটি অনুসরণ করবে।
বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে প্রায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে। এ কোর্স সূচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ। ২০০২ সালে অনুষদের চারটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু করা হয়। এখন তা অনেক গুণ বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ইভিনিং মাস্টার্স, ডিপ্লোমা কোর্স, স্পেশালাইজড মাস্টার্সসহ বিভিন্ন নামের সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে।
ইউজিসির নির্দেশনার পর সন্ধ্যাকালীন এসব কোর্সের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিভাগ বা কোর্স হঠাৎ করে খোলা বা বন্ধ করা হয় না। এজন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। রাষ্ট্রপতির অনুশাসন অনুযায়ী গত মে মাসে বিভিন্ন নামে পরিচালিত সান্ধ্য কোর্সের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ডিনদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা সান্ধ্য কোর্স বিষয়ে মতামত দেবেন। বন্ধ করা হলে সেটি কবে থেকে, সে বিষয়েও মতামত দেবেন তারা। সে আলোকে ক্রমান্বয়ে সান্ধ্য কোর্স বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়টি অনুষদের অধীনে বিভাগ রয়েছে ৫৯টি। আর ইনস্টিটিউট রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে ১৪টি বিভাগ ও একটি ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স চালু আছে ১৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ-জেইউ) প্রথম সন্ধ্যাকালীন ও সাপ্তাহিক কোর্স চালু করে। এরপর ধীরে ধীরে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি), ইংরেজি বিভাগ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ এবং গণিত বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগে সাপ্তাহিক প্রাইভেট কোর্স চালু হয়।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪টি বিভাগে চালু রয়েছে সন্ধ্যাকালীন কোর্স। গত বছর সব সান্ধ্য কোর্স বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরও শিক্ষকদের অনুরোধে পুনরায় কোর্সগুলো চালু করা হয়।
অপেক্ষাকৃত নতুন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঁচটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে। ইউজিসির নির্দেশনা পেলে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের আসন্ন সমাবর্তনে সন্ধ্যাকালীন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। আমরা ইউজিসির চিঠি পাওয়ামাত্রই সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করে দেব।
এর বাইরে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আট, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু রয়েছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক ;পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চালু হওয়া এসব সান্ধ্য কোর্সের তীব্র সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে তিনি বলেন, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। একশ্রেণীর শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন, যাতে শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন ডিপার্টমেন্ট, সান্ধ্য কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও একশ্রেণীর শিক্ষক ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। আবার কিছু শিক্ষক আছেন, যারা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। কিন্তু সান্ধ্য কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে তারা খুবই সিরিয়াস। কারণ এগুলোতে নগদ প্রাপ্তি থাকে।
রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বন্ধের এ নির্দেশনা দিল ইউজিসি। পাশাপাশি উপাচার্যদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং নতুন বিভাগ ও পদ সৃষ্টিতে ইউজিসির পূর্বানুমোদন গ্রহণ, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসরণসহ ১৩টি নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে উপাচার্যরা নিজেদের মেধা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালন করে যাচ্ছেন। তবুও নানা কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি অনুসরণে শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে উচ্চশিক্ষা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, যা কাম্য নয়।
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের আইন মেনে চলতে চিঠিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিধিবহির্ভূতভাবে ‘সেশন বেনিফিট’ সুবিধা প্রদান এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিম্নতর গ্রেড থেকে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত করা বাঞ্ছনীয় নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হচ্ছে, এমনকি পদোন্নতি ও পদোন্নয়নের ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে। সরকারের আর্থিক বিধি লঙ্ঘন করে দেয়া হচ্ছে ভূতাপেক্ষ জ্যেষ্ঠতা। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, বিধি-বিধান এবং সরকারের নিয়ম-নীতি প্রতিপালন করা অবশ্যকর্তব্য।