মানিক মুনতাসির কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই এক ব্যাংকের পরিচালকরা আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন ইচ্ছামতো। নামমাত্র ব্যবসায়ী, ব্যাংক পরিচালক, ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজনীতিকের সংঘবদ্ধ চক্র সুকৌশলে লুট করছে ব্যাংকের টাকা। ভুয়া কাগজপত্র মর্টগেজ হিসেবে দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন এই জালিয়াতরা। আবার কোনো মর্টগেজ ছাড়াই করপোরেট গ্যারান্টির নামে দেদার ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এসব কাজ হচ্ছে ব্যাংক মালিক, ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ও জালিয়াত চক্রের যোগসাজশে। ফলে ব্যাংক খাত থেকে প্রতিনিয়ত বেরিয়ে পড়ছে জনগণের গচ্ছিত টাকা। যাচ্ছে, আর ফিরে আসছে না। সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, শুধু ব্যাংক পরিচালকরাই ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন; যা মোট বিতরিত ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে সব ধরনের দায় এড়াতে এবং অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কমাতে ও ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল রিপোর্ট ভালো দেখাতে অবলোপন করা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পূর্ণ ভুল নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। এখানে ঋণখেলাপিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। আর নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের। এ খাতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ফেরাতে হলে সবার আগে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। অন্যথায় ব্যাংক খাত রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংকের মালিকরাই ব্যাংকে জনগণের গচ্ছিত টাকা ইচ্ছামতো আত্মসাৎ করছেন। এতে ব্যাংকের ওপর থেকে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। এজন্য ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও অধিক হারে যাচাই-বাছাইায়ের পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে করপোরেট গ্যারান্টির বিপরীতে দেওয়া ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে দেওয়া জমি-জিরাত বন্ধকের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। জামানতবিহীন করপোরেট গ্যারান্টির নামে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন ইচ্ছামতো। এ ক্ষেত্রেও কড়াকাড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ঋণের নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাগজপত্রের অডিট করা। পরিচালকদের ঋণের ব্যাপারে আওা সতর্ক থাকা দরকার। একই সঙ্গে ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমডিদের বেলায়ও এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণ অনিয়মের জন্য তারাও দায়ী থাকেন। সম্প্রতি ব্যাংক খাতের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যাপারে এমন ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফলে এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। এদিকে গত বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে যে তথ্য দেন তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৫৫টি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এ অঙ্ক ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকাও প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্যভান্ডারের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংসদে ওই তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮ হাজার ২২৩। সূত্র জানান, ব্যাংকগুলোর এখন পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ৪ হাজার ১৯৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অর্থ আদায় হয়নি। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মাত্র ২৫ হাজার ৮৩৬ কোটি ৪ লাখ টাকা আদায় হয়েছে। এর বাইরে একই সময় পর্যন্ত অবলোপন করা খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে বেনামি ঋণ। এসব মিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা; যা মোট ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সমঝোতার ভিত্তিতে বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক ব্যাংক পরিচালক; যাদের কয়েকজন বেশি বিতর্কিত। মূলত এদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি। তারা পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের ক্ষতির পাশাপাশি সাধারণ ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন না। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অপরাধে জড়িত ব্যাংকের নিজস্ব লোকজন। বিশেষ করে পরিচালকদের হাত রয়েছে সবচেয়ে বেশি। পরিচালকরা বর্তমানে একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করেও ঋণ নিচ্ছেন।
ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানান, আগে নিজ ব্যাংক থেকেই পরিচালকরা বেশি ঋণ নিতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান বিধি অনুযায়ী পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারছেন না। তবে তাদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোনো বাধা নেই। ফলে পরিচালকরা এখন পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে যেমন ঋণ নিচ্ছেন, তেমন প্রভাব খাটিয়ে নানা সুবিধাও নিচ্ছেন। এদিকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করা হচ্ছে না। এমনকি ব্যাংক পরিচালকের কাজের লোক, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শির নামে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছেন না। এভাবেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পুরোপুরি মেরে দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। পরে বছরের পর বছর অনাদায়ী দেখিয়ে এক পর্যায়ে তা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া ভুয়া কাগজপত্র, জাল দলিল, ভুয়া এফডিআর মর্টগেজ হিসেবে দেখিয়ে যাচাই-বাছাই না করে আবেদনকারীদের বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণের বিপরীতে রাখা জামানতের সম্পত্তিতে সাইনবোর্ড লাগানোর নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির অভাব, যথাসময়ে অডিট না হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিট ঠিকমতো না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে দেশের পুরো ব্যাংক খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংককে দেওয়া কাগজপত্রের ঠিকানা অনুযায়ী গ্রাহকের খোঁজ পায় না ব্যাংক। খোঁজ পেলেও আইনি জটিলতায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করলেও তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। তাই ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে ঋণের কিস্তি না পেয়ে নির্দিষ্ট সময় পর ওইসব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, একটি প্রতারক চক্র কখনো কখনো ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নাম ভাঙিয়েও ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।