মো. আব্দুল্লাহ আল হোসাইন
এক দিকে সরকারি-বেসরকারি অফিস চলছে পুরোদমে, অন্যদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে চলমান বিধিনিষেধে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলছে ঢাকার গণপরিবহন। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন অফিসগামী যাত্রীরা।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সকাল ও সন্ধ্যায় বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, বাসের দরজা বন্ধ থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঠেলে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টার মতো ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। আর সরকারঘোষিত দফায় দফায় ‘লকডাউন’ ও ‘বিধিনিষেধের’ মধ্যে দেখা যাচ্ছে, গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কঠোরতা শুধু অর্ধেক যাত্রী নেওয়াতে, অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো উপেক্ষিত।
গণপরিবহনের সংকট ছিল স্বাভাবিক সময়েও। করোনাভাইরাসের চলমান বিধিনিষেধের সময় তা বেড়েছে। ঢাকা মহানগরের ভেতর প্রায় চার হাজার বাস চলাফেরা করে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। প্রতি বাসে আসনসংখ্যা গড়ে ৪০টি। সেই হিসাবে মোট আসন বা যাত্রী ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো। পাশাপাশি সকাল ও সন্ধ্যায় অফিসগামী যাত্রীদের দাঁড়িয়ে যেতেও দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বাসগুলো যাত্রী নিচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার।
ঢাকায় দৈনিক প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ যাত্রী পরিবহন হয় বলে দেখা গেছে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকার কয়েক বছর আগে করা এক সমীক্ষায়। এই যাত্রীদের একটি বড় অংশ অফিসগামী। তাঁদের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে বাসগুলো যাত্রীর চাপ সামাল দিতে পারছে না
শাকিল আহমেদের অফিস মহাখালীতে। আজ সোমবার সকালের দিকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের ভাড়া ঠিকঠাক করছিলেন তিনি। শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বেশ বিড়ম্বনা হচ্ছে। বিআরটিসি বাসের জন্য লাইনে ১ ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়েও বাস পাইনি। এখন পাঠাও (মোটরসাইকেল সার্ভিস) দেখছি, তবুও পাওয়া যাচ্ছে না। …দুই মাস ধরে সমস্যাটা হচ্ছে। এখন ঠিক সময়ে অফিসে যেতে প্রতিদিন অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠতে হচ্ছে।’
মোহাম্মদপুর-মহাখালী রুটে আগে তরঙ্গ বাস, টেম্পুতেও অফিসের সময়ে চলাচল করতেন শাকিল আহমেদ। এখন একমাত্র সাশ্রয়ী পরিবহন বিআরটিসি বাস, তা–ও চলছে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে।
যদিও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যাঁরা মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালাচ্ছেন, তাঁরা মহাখালী যেতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা চাচ্ছেন। প্রতিদিন এত টাকা দিয়ে যাওয়া আসা সম্ভব?’
একই সমস্যায় পড়েছেন হাইকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন। মোহাম্মদপুরে মিডলাইন বাসের জন্য সকাল ১০টার দিকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসের জন্য আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বাস একেবারেই নাই। এখন চাপ অনেক বেশি। এটিসিএলের মতো কয়েকটি সিটিং সার্ভিসও একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড় ছিল, কিন্তু যেতে পারতাম। এখন শুধু মিডলাইন চলে। বাস (সার্ভিস) একটা, যাত্রী নিচ্ছে অর্ধেক। ভিড় অনেক বেড়ে গেছে।’
নূরে জান্নাত সাইন্সল্যাবের একটি অফিসে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘দুই সিটে একজন হওয়ায় প্রায়ই অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
বাস ঘেরাও অফিসগামী যাত্রীদের
অফিসগামী যাত্রীরা বাসে উঠতে না পারায় কোনো কোনো জায়গায় বাসস্ট্যান্ডে থাকা বাস ঘেরাওয়ের ঘটনাও ঘটছে কয়েক দিন ধরে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাত্রী অর্ধেক বহন করার কারণে (অফিসগামী) যাত্রী যেতে পারছেন না। অনেকে বাসে ব্যারিকেড দিয়ে উঠতে চাচ্ছেন।’
গত কয়েক দিনে ঢাকা কলেজ এলাকা, শাহবাগ মোড়, যাত্রাবাড়ীতে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানান খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘আজ খিলক্ষেত এলাকায় অফিসগামী যাত্রীরা বাস ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও উপায় না দেখে যাত্রী উঠিয়ে দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রী নেওয়ার।’
অন্যদিকে করোনাভাইরাসে বিধিনিষেধের মধ্যে দাবির মুখে ঈদের আগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে ঢাকায় গণপরিবহন খুলে দেওয়া হয়। মাঝে অফিসগামী যাত্রীদের ভিড় সামাল দিতে ধারণক্ষমতার অর্ধেকের বেশি যাত্রী তোলা শুরু করে গণপরিবহনগুলো।
কিন্তু সম্প্রতি আবার অর্ধেক যাত্রী তোলার বিষয়ে কঠোর হয়েছে প্রশাসন। মালিক-শ্রমিক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ম্যাজিস্ট্রেটদের আটটি দল ঢাকার বিভিন্ন অংশে অভিযান চালাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে দলগুলো কাজ করছে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
এসব কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অফিসগামী যাত্রীরা।
শুধু অর্ধেক যাত্রীতেই কঠোরতা, উপেক্ষিত অন্য স্বাস্থ্যবিধি
ঢাকার গণপরিবহনগুলোতে, বিশেষ করে বাসে দেখা গেছে, শুধু অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের বিষয়েই জোর বেশি। অন্যান্য বিষয়গুলো একেবারেই উপেক্ষিত।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই স্বাভাবিক সময়ে রাজধানী ও শহরতলিতে যানবাহনের সংকট লক্ষ করি। এর মধ্যে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল একটি ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন ছিল, যত সিট, তত যাত্রী পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যবিধিতে কঠোর হওয়া। আমরা শুধু সিটের বিষয়ে কঠোর হচ্ছি, অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ দেখছি না। যে যাত্রী বাসের হ্যান্ডেল ধরে উঠছে, তা কি স্যানিটাইজ করা হয়? অসুস্থ যাত্রী যে গণপরিবহনে করে হাসপাতালে যাচ্ছে, তা কি নিরাপদ করা হয়? তাই শুধু অর্ধেক যাত্রী নিলেই হবে না, বাকি ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়ে গেছে।’
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মনে করেন, বাংলাদেশে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন পরিচালনা বাস্তবসম্মত নয়। এখানে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিতে কঠোর হয়ে বরং বাসে শতভাগ আসনে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ দেওয়া উচিত।