নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনার চলমান মহামারীর সময়ে স্বাস্থ্য খাতে ‘দুর্নীতি, অনিয়ম ও টিকা অব্যবস্থাপনার’ পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর কর্তৃত্বহীনতার অভিযোগ নিয়ে সংসদে গতকাল তোপের মুখে পড়েন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্ব সংসদের বাজেট অধিবেশনে গতকাল ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খাতে’র অতিরিক্ত মঞ্জুরি দাবির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দলের সদস্যরা স্বাস্থ্য খাতে নানা ‘দুর্নীতি, অনিয়ম ও টিকা অব্যবস্থাপনার’ অভিযোগ তুলে ধরেন। এ সময় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। আপনার বাবা আমার সঙ্গে মন্ত্রী ছিলেন। আপনাকে আমি চিনি। অত্যন্ত ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে আপনি। কিন্তু আপনার তো কর্তৃত্ব নেই, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যা হচ্ছে!’ তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে অক্সিজেন নেই। এখন দরকার অক্সিজেন। সেটা না এনে আনা হচ্ছে এমআরআই, সিটিস্ক্যান মেশিন। পাঠানো হচ্ছে উপজেলায়। তারা সব সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। চালাতে পারে না। লাখো কোটি টাকা যাচ্ছে। কিন্তু জনগণ সেবা পাচ্ছেন না।’ কাজী ফিরোজ রশিদ আরও বলেন, ‘চুরি-ডাকাতি করলে একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা যায়। কিন্তু আইন কেন নিজের হাতে তুলে নেওয়া হলো, তাকে (রোজিনা ইসলাম) ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হলো। তাকে টয়লেটে যেতে দেননি। অসুস্থ মানুষ, তাও মহিলা। তাকে এভাবে হেনস্তা করা যায়? এটা নিয়ে জাতিসংঘ, সারা পৃথিবী কথা বলল। আমাদের মুখটা কোথায় গেল? নিজেদের দুর্বলতা নিজেদের ঢাকতে হয়।’
জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নান বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আফজাল-মালেকরা অনিয়ম করছে রূপকথার গল্পের মতো। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এখন কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু তাদের থামানো যাচ্ছে না। এখানে অনেক মালেক, আফজালের ছড়াছড়ি। একজন মহিলা উপসচিবের কানাডাসহ তিনটা দেশে বাড়ি আছে।’
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘কেনাকাটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতির ডিপো। কীভাবে এ মন্ত্রণালয়ের সংস্কার করবেন, তা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগকে সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। বেহাল দশা থেকে রক্ষা করতে কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকায় এক পদে ৫০ জন চিকিৎসক, আর জেলা-উপজেলায় চিকিৎসক নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারত কেন চুক্তির বরখেলাপ করল? ২০ লাখ মানুষ এক ডোজ টিকা পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। তাদের আরেক ডোজের কী হবে, ঠিক নেই। কবে করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হবে, সেটা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। প্রয়োজনে টিকা আনা বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কিন্তু সজাগ থাকতে হবে, যেন ?দুর্নীতি না হয়। বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার কোম্পানি টিকা এনেছে।’
বিএনপির ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ‘গত ১০ মাসে স্বাস্থ্য খাতে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা-এডিপির মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এখন আবার নতুন বরাদ্দ চাইছে। কেন ৭৫ শতাংশ অব্যবহৃত রয়ে গেছে তার জবাব স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার জেলায় জেলায় আইসিইউ স্থাপন করতে বলেছেন। কিন্তু দেড় বছরে মাত্র পাঁচটি জেলায় নতুন আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে। এখনো ৪৫টি জেলায় আইসিইউ নেই।’ তিনি বলেন, ‘করোনাকালেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাও ব্যবহার হয়নি। করোনাকালে ভারত স্বাস্থ্য খাতে আগের বছরের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। বাংলাদেশে বেড়েছে মাত্র ১২ শতাংশ।’
বিএনপির মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকারকে প্রশাসন নির্ভরতা কমাতে হবে। যে যার অবস্থানে রয়েছে তাকে তার মর্যাদা দিতে হবে। ইউএনও ডিসি তার জায়গায় কাজ করবে, এমপি, উপজেলা ও ইউপ চেয়ারম্যান তার জায়গায় কাজ করবে। কিন্তা তা হচ্ছে না। তারা (ডিসি-ইউএনও) হরিলুট করছে। আবার সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকের গলা চিপে ধরে হেনস্তা করেছেন, এটা হতে পারে না। মানুষের কষ্টে উপার্জিত ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় আমারা মেগা প্রকল্প করছি, তা যেন দেশের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়।’ স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিতে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হয়নি : স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হয়নি। দুর্নীতিতে জড়িতরা জেলে আছেন।
গতকাল জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ খাতের অতিরিক্ত মঞ্জুরি দাবির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের সময় উত্থাপিত অভিযোগের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন চলমান।
করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার তা নিচ্ছি।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে খুবই সফলতা দেখিয়েছে। করোনায় আমরা মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। ওষুধের অভাব হয়নি। অক্সিজেনের অভাব হয়নি। ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছি। ভ্যাকসিন সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কিনছি। চীন, রাশিয়া থেকে আনার ব্যবস্থা করছি, চুক্তি হয়েছে। চীন ৫ লাখ টিকা উপহার দিয়েছে। আরও ৬ লাখ আগামী ১২-১৩ তারিখে আসবে। বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে খুবই সফলতা দেখিয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬ শতাংশে আছে। অনেক বড় বড় দেশ এটা পারেনি বলে ধরাশায়ী হয়েছে। বাংলাদেশ সেটা পেরেছে বলে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক আছে।