খাইরুল বাশাররক্ত পরীক্ষায় ব্যবহৃত ছোট্ট একটি টিউবের সর্বোচ্চ খুচরামূল্য দুই হাজার টাকা। এ হিসাবে ৫০টি টিউব কিনতে লাগার কথা ১ লাখ টাকা। কিন্তু সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল তা কিনেছে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি টিউবের পেছনে প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় দেখিয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ বাজারে এ ধরনের টিউব ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় পাওয়া যায়।
মেডিকেল সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির এমন ভয়ংকর চিত্র উঠে এসেছে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট আপত্তিতে। শুধু তা-ই নয়, বাজারে যে ডিসেক্টিং টেবিল ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে পাওয়া যায়, হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ একই ধরনের দুটি টেবিল কিনেছে প্রায় ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ একটি টেবিলের দাম পড়েছে ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অথচ বাজারে এ ধরনের টেবিল ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় অহরহ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল দেশ রূপান্তরকে জানান, অডিট আপত্তির বিষয়ে তারা তাদের জবাব দিয়েছেন। বাড়তি অর্থ ব্যয়ের যে বিষয় বলা হয়েছে, তা চালানের মাধ্যমে ফেরত দেওয়া হয়েছে। তবে টাকা ফেরতের পক্ষে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগের) অতিরিক্ত সচিব শাহাদাত হোসেন দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২০ সালে তাদের করা অডিট এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আপত্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে জবাব চাওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোলে ২০১৪ সালে জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এম মনসুর আলীর নামে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর ২০১৯ সালে এটির যন্ত্রপাতি ও আসবাব কেনাকাটায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এরপর তদন্তে নেমে দুর্নীতির সত্যতা পেয়ে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পালসহ দুজনের বিরুদ্ধে গত বছর ৯ আগস্ট মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ৩০ কোটি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। ডলার ও ইউরো করে এসব অর্থ হংকং পাঠানোর দায়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুদকের এ মামলায় এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। ওই দুর্নীতির রেশ কাটতে না কাটতেই ফের অস্বাভাবিক দামে সরঞ্জাম কেনার অভিযাগ উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট আপত্তিতে।
একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, রক্ত পরীক্ষায় থাকে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি)। সিবিসির মাধ্যমে ব্লাড সেল টাইপ ও ব্লাড সেলের কাউন্ট বা পরিসংখ্যান দেখা হয়। সিবিসির অন্যতম হলো রেড ব্লাড সেল কাউন্ট (আরবিসি)। আর এই আরবিসি পরীক্ষায় ব্যবহৃত অতি ক্ষুদ্রাকার টিউব হলো আরবিসি কাউন্টার।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ প্রতি পিস আরবিসি কাউন্টার কিনেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ টাকায়। কিন্তু স্বয়ং স্বাস্থ্যের অডিট আপত্তিতে বলা হয়েছে, বাজারে আরবিসি কাউন্টারের সর্বোচ্চ খুচরামূল্য দুই হাজার টাকা। আরবিসি কাউন্টারের মূল্য জানতে ঢাকায় চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রির সর্ববৃহৎ পাইকারি মার্কেট বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনে গিয়ে এ প্রতিবেদক দামে বিস্তর ফাঁরাক পান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে জানান, আরবিসি কাউন্টার টিউব ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এর বেশি কখনো হবে না। অডিটেও যেখানে প্রতি আরবিসি কাউন্টার দুই হাজার টাকা বলা হয়েছে, সেখানে ৫০টি আরবিসি কাউন্টার কিনতে হাসপাতালটি খরচ করেছে ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
অডিট আপত্তির প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাসপাতালের জন্য স্টেইনলেস স্টিলের (এসএস) দুটি ডিসেক্টিং টেবিল কেনা হয়েছে। এগুলো সাধারণত অ্যানাটমি বিভাগে ব্যবহার করা হয় মরদেহ কাটাছেঁড়ার কাজে। ডিসেক্টিং টেবিল সাধারণ টেবিলের মতোই। আলাদা তেমন বিশেষত্ব না থাকলেও টেবিল দুটির জন্য হাসপাতাল ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছে। অথচ অডিটেই এ ধরনের টেবিলের সর্বোচ্চ দাম ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বলা হয়েছে। বিএমএ ভবনের বিক্রেতারা বলেন, ‘ডিসেক্টিং টেবিল বিভিন্ন ধরন ও আকৃতির হয়। কাটাছেঁড়ার জন্য কেউ টেবিলটি বড় বানালে খরচ একটু বেশি পড়ে। এরপরও ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার মধ্যে ডিসেক্টিং টেবিল পাওয়া যায়।’
অডিট বলছে, দুটি ডিসেক্টিং ও একটি অটোপসি টেবিল কিনতে হাসপাতাল ৯৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে। সরকারি মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে ব্যবহৃত এ ধরনের অটোপসি টেবিলের সর্বোচ্চ দাম ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তবে বাজারে যাচাই করে দেখা যায়, ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের অটোপসি টেবিল পাওয়া যায়।
হাসপাতালটি একটি রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন কেনার জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার এবং একই মডেলের একই দেশের আরেকটি রিয়েল টাইম পিসিআর কেনার জন্য ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করেছে। কিন্তু সরকারের অডিট বলছে, দুটি রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিনের জন্য ২৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে, যা ফেরতযোগ্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা তো এটির (অডিট আপত্তি) উত্তর দিয়েছি।’ স্বাস্থ্যের নিজস্ব অডিটে যে পণ্য দুই হাজার টাকা বলছে, সেটি কীভাবে আপনারা ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায় কিনলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না, না, আমরা তো এসব বিষয়েও তাদের উত্তর দিয়েছি। ওটার টাকাও ফেরত দিয়েছি।’ কার কাছে ফেরত দিয়েছেন এমন প্রশ্নে ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল বলেন, ‘টাকা চালানের মাধ্যমে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
তবে এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট অনুবিভাগের) অতিরিক্ত সচিব শাহাদাত হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০২০ সালে এ অডিট করা হয়। এগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমরা আমাদের আপত্তির বিষয়ে জবাব চাইব।’ সরঞ্জাম কেনাকাটয় দুর্নীতি হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওটা তো ডিপিপির যে দাম, তাই ধরা হয়েছে। ওগুলারে ইয়ে করা হইছে।’
জনগণের টাকায় সরকারি পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল বলেন, ‘ওটা তো ডিপিপির মাধ্যমে করা হয়েছে; যা ছিল তাই হয়েছে। এখন আমরা তো ওদের সঙ্গে আলোচনা করছি।’
একপর্যায়ে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি এ প্রতিবেদক কোথায় আছেন জানতে চান এবং মোবাইলে না বলে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ডা. কৃষ্ণ কুমার পাল বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব। আপনি আসেন, আমি দেখা করব।’
অডিট পরিচালনা করা সিভিল অডিট অধিদপ্তরের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার আব্দুল কুদ্দুস প্রধান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায়ে অডিট করি। আমাদের আপত্তিগুলো সঠিক না হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ তাদের যুক্তি তুলে ধরতে পারে। তাদের যুক্তি না টিকলে এবং আমাদের আপত্তিই যদি সঠিক হয়, তাহলে তাদের টাকা জমা দিতে হবে।’
সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয়ে ঢালাওয়ের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করার কথা জানান। শহীদ এম মনসুর আলী হাসপাতালের সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠানো হলে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে ভালো হবে। আর মন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমি আপনাকে জানাব।’ কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ করা হয়নি। এমনি যে নম্বর থেকে কল করে এসব বলা হয়েছিল, সে নম্বরে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩ হাজার অডিট আপত্তি রয়েছে। হঠাৎ করে বললে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে ২০২০ সালের অডিটগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছে জবাব চাইব। তাদের কাছে বক্তব্যের সপক্ষে নথিসহ ব্রড সিটে জবাব চাওয়া হবে। জবাব আসার পর পরীক্ষা করে দেখব অডিট আপত্তি বিভাগ থেকে তাদের জবাব গ্রহণযোগ্য কি না? গ্রহণযোগ্য হলে আমরা সেটি তুলে নেওয়ার সুপারিশ করব। আর গ্রহণযোগ্য না হলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে বলা হবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত দেবে অডিট ডিপার্টমেন্ট।’
এ বিষয়ে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. আমীরুল হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাসপাতালের বিষয় তো আমি জানি না। আমি মেডিকেল কলেজের। হাসপাতাল আলাদা বিভাগ। এ জন্য আপনি সেখানকার পরিচালককে ফোন করেন।’
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতির এ ধরনের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দুই ধরনের পদক্ষেপ হতে পারে। একটি বিভাগীয় পদক্ষেপ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেই অবাস্তব মূল্যের সরঞ্জাম কেনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা মনে করি, এই এখতিয়ার তাদের রয়েছে। অন্যদিকে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা অবশ্যই বৈধ আয়ের পাশাপাশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছে। কাজেই দুদক তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
ইনফোগ্রাফ
১. আরবিসি কাউন্টার
রক্ত পরীক্ষায় ব্যবহৃত ক্ষুদ্রাকার টিউব হাসপাতাল কিনেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৮০০ টাকায়, বাজারমূল্য ৩০০-৫০০ টাকা
২. ডিসেক্টিং টেবিল
লাশ কাটাছেঁড়ার কাজে ব্যবহৃত টেবিল
হাসপাতাল কিনেছে ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকায়, বাজারমূল্য ৫-২০ হাজার টাকা
৩. অটোপসি টেবিল
ফরেনসিক বিভাগে ব্যবহৃত, হাসপাতাল কিনেছে ২৪ লাখ ২৩ হাজার, বাজারমূল্য ১০-২০ হাজার টাকা