আলী ইব্রাহিমএকের পর এক প্রতারণার ঘটনায় উন্মোচিত হয়েছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মুখোশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা রুখতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়। ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেল মুখে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও ভেতরের চিত্র ভিন্ন। ইতোমধ্যে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে এবং পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের টাকা পরিশোধ না করে অফিস বন্ধ করে দিয়েছে ইভ্যালি। এমনকি ইভ্যালির হটলাইনে ফোন দিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডির অফিসের সামনে প্রতিদিন ভিড় করছেন গ্রাহক ও পাওনাদার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। একে একে ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলেও পাওনা টাকা বুঝে পায়নি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। নানা টালবাহানায় এড়িয়ে গেছে ইভ্যালি। ইতোমধ্যে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) ইভ্যালির সদস্যপদ কেন বাতিল করা হবে না মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছে। এর আগে এমডি ও চেয়ারম্যানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক। সর্বশেষ অফিস ও হটলাইন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে গেছেন প্রতিষ্ঠানের এমডি-চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সাধারণ গ্রাহক ও পাওনাদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর শত শত কোটি টাকা এখন ইভ্যালির পেটে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় হাওয়া হয়ে যাওয়া ইভ্যালির এই গ্রাহক ও পাওনাদারদের টাকার কী হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ, ভোক্তা অধিকার এবং সোস্যাল মিডিয়ার অভিযোগ আমলে নিয়ে দেশে অনলাইন ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানের সংগঠন ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) ইভ্যালিসহ বেশি কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সনদ কেন বাতিল করা হবে না- এই মর্মে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে। সংগঠনের ৯ এর ডি ধারায় এই নোটিস করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে চিঠির জবাব দিতেও বলেছে ইক্যাব। এদিকে ইভ্যালির প্রতারণার কারণে একে একে সম্পর্ক ছিন্ন করছে পণ্য সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক দিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের ম্যাসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে, ইভ্যালির দেয়া ভাউচারে তারা আর পণ্য সরবরাহ করবে না। কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ইভ্যালির কাছ থেকে পণ্যের দাম পাচ্ছে না। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের কার্ডে ইভ্যালিতে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইভ্যালির প্রতারণার কারণে ইতোমধ্যে দেশীয় পোশাকের অন্যতমও ব্র্যান্ড রঙ বাংলাদেশ, জেন্টল পার্ক, ট্রেন্ডস, আর্টিসানসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ভাউচারে পণ্য সরবরাহ না করার কথা তাদের গ্রাহকদের জানিয়েছে।
শুধু এসব নামি-দামি প্রতিষ্ঠানেরই টাকা বকেয়া রাখেনি ইভ্যালি; এর বাইরে ইভ্যালির ইফুডে খাবার বিক্রি করেও সরবরাহকারীরা টাকা পায়নি। এমনি এক ছোট ব্যবসায়ী মোশারফ। সাভারের হেমায়েতপুরের এই ব্যবসায়ী ইফুডে খাবার সরবরাহ করে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ইভ্যালি থেকে পাওনা বুঝে পাননি। এবার ইভ্যালির প্রধান অফিস বন্ধ হওয়াতে চরম বিপাকে পড়েছেন খাবার সরবরাহকারী এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। শুধু মোশারফই নন, প্রতিদিনই এমন অনেক পাওনাদার পাওনা নিতে ভিড় করছেন ইভ্যালি অফিসে। পণ্য ও অর্থ ফেরত না পাওয়া গ্রাহকরাও প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ভিড় করতে শুরু করেছেন। একদিকে কার্যালয় বন্ধ, অন্যদিকে হটলাইনও বন্ধ করে রেখেছে ইভ্যালি।
এদিকে ইভ্যালিসহ ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে সিআইডি। এতকিছুর পরও থেমে নেই ইভ্যালির প্রতারণা। প্রতিষ্ঠানটি এখনো বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডার নেয়া অব্যাহত রেখেছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেরিয়ে আসে ইভ্যালির অপকর্মের নানা তথ্য। এতে দেখা গেছে, কোম্পানির সম্পদের চেয়ে দায়ের পরিমাণ প্রায় ৬ গুণেরও বেশি। এতে নড়েচড়ে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মোহাম্মদ রাসেলের সম্পদের তদন্ত শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির এমডি ও চেয়ারম্যানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার ও সোস্যাল মিডিয়ায় ইক্যাবের কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে আমরা সংগঠনের ৯ এর ডি ধারায় ইভ্যালিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ কেন বাতিল করা হবে না- এই মর্মে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এর জবাব দিতেও বলা হয়েছে ইক্যাবের পক্ষ থেকে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইন নিবন্ধন নিয়ে এমএলএম ব্যবসা করছে তাদেরও কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা- যেখানে কোম্পানিটির চলতি সম্পদ মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। গ্রাহক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার চলতি সম্পদ দিয়ে কোনো অবস্থাতেই কোম্পানিটির এই দায় পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই। পণ্যমূল্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়ে ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকার পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। অন্যদিকে ইভ্যালি যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কিনে ওই সব ব্যবসায়ীর কাছে কোম্পানিটির বকেয়া রয়েছে ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ইভ্যালির সব চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে এবং আরো ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব হবে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর বছর থেকেই লোকসানে রয়েছে ইভ্যালি। প্রথম বছর কোম্পানিটির নিট লোকসান ছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। দিনে দিনে ইভ্যালির লোকসান বেড়েই চলছে।
ইভ্যালির প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ইভ্যালিকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে ই-কমার্স একটি উদীয়মান খাত। এই খাত আরো বিকশিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সময়ে এই ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো ই-কমার্স। তবে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে- এটা একটা ভালো দিক বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের সেল ফোনে বারবার কল দেয়ার পরও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে তাকে খুদে বার্তা পাঠানোর পরও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।