যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব সংলাপে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার আলোচনা হয়েছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা যে এখনই উঠছে না তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। বিষয়টিকে জটিল ও সমস্যার ইস্যু বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। যদিও গত তিন মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির কথা জানিয়েছেন তারা। গতকাল রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অষ্টম অংশীদারিত্ব সংলাপ অনুষ্ঠানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে এসব আলোচনা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে অষ্টম পার্টনারশিপ ডায়ালগে যোগ দিতে গত শনিবার ঢাকা আসেন রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। গতকাল সকালে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সংলাপে বসে দুই দেশ। এ আলোচনায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। আর ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড নেতৃত্ব দেন মার্কিন প্রতিনিধি দলের। সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে লিখিত বক্তৃতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আলোচনায় র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরেছি। সন্ত্রাস ও আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এটি যে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, শুধু সেটিই বলা হয়নি, পাশাপাশি সরকারের পদক্ষেপের কথাও জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা তাদের একটা কূটনৈতিক পত্র দিয়েছি। সেখানে র্যাবের কর্মকান্ড ও আমাদের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। তারা এটা ওয়াশিংটনে নিয়ে আলোচনা করবেন। আমরা আলোচনা চালিয়ে যাব। বিভিন্ন ফরম্যাটে এ নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করছি, যথা সময়ে বিষয়টির সুরাহা করতে পারব।
অংশীদারিত্ব সংলাপে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কী আলোচনা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারি, বিষয়টি জটিল ও সমস্যার ইস্যু। আমরা এ নিয়ে আজ আলোচনা করেছি। তবে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে একটি ছোট পরিসর ছিল বিষয়টি।’ তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, র্যাবের কর্মকান্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম নিয়ে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। এটা উল্লেখ করার পরও বলছি, গত তিন মাসে আমরা এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি। তবে বিষয়গুলো সুরাহার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন আলোচনায় উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের যে জিরো টলারেন্স, সেটি তিনি উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য যে কাজ চলছে, সেটিও তিনি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আমাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের কর্মপরিকল্পনা তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। কারণ, সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞা রেখে সম্পর্ক নিবিড় করা কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ বসে থাকে না। যখন মৌলিক আইনের লঙ্ঘন দেখতে পাই, আমরা এ বিষয়ে কথা বলি। আমরা ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে কথা বলব। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা ইস্যুতে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, আমরা নিহত বাংলাদেশিদের স্মরণে শোক জানাচ্ছি। ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশেও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের অনেক পেশাজীবী ও শিক্ষার্থী সেখানে রয়েছেন। বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই জানে, বিনা উসকানিতে সেখানে নৃশংস আগ্রাসনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আগ্রাসন চালানো হয়েছে। রাশিয়ার এই অভিযানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়িয়ে আমরা কূটনীতিকভাবে এর সমাধানের চেষ্টা করেছি। তাই সব গণতান্ত্রিক দেশকে এক হতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, এই যুদ্ধ অবসানে সত্য উচ্চারণে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সবাই উচ্চকণ্ঠ হবে। এর আগে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে যখন গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক আইন হুমকির মুখে, তখন বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
বিনিয়োগে পরিবেশের উন্নতি প্রয়োজন : ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। তবে বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো করতে বাংলাদেশের আরও অনেক কিছু করা দরকার। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, আমরা এ নিয়ে কথা বলেছি। ব্যাপকতর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের (আইপিএস) প্রেক্ষাপট থেকে বলা যায়, আমরা এ অঞ্চলের সব অংশীদার ও জোটের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা তো মনে করি, ক্রমবর্ধমান ব্যবসা ও বাণিজ্যের নানা ক্ষেত্রে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি। প্রযুক্তি, অবকাঠামো, টেকসই অর্থনীতির পাশাপাশি বিশেষ করে সামুদ্রিক নিরাপত্তাসহ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা অনেক কিছু একসঙ্গে যেমন করতে পারি, তেমনি এই অঞ্চলের দেশগুলোকে যুক্ত করেও পারি। আমরা এটা করতে চাই।
দুই চুক্তির প্রস্তুতি : বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিটারি ইস্যুতে জিসমিয়া ও আকসা নিয়ে দুটি চুক্তির খসড়া তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড। তিনি বলেছেন, আগামীতে এগুলো চুক্তিতে রূপ নিতে পারে। ন্যুল্যান্ড বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক এগিয়েছে। আগামীতে আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিটারি ইস্যুতে জিসমিয়া ও আকসা নিয়ে দুটি চুক্তির খসড়া তৈরি করা হয়েছে। যা আগামীতে চুক্তিতে রূপ নিতে পারে।