মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ৫১৩ জন কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির স্কুল শাখার এক শিক্ষা কর্মকর্তা (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার)। গত শুক্রবার দুপুরে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর তার সমাধান বের করে সারাদেশে চক্রের কাছে তিনি উত্তরপত্র পাঠিয়ে দেন। চক্রের অন্যতম সদস্য গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মূলহোতা সেই বিসিএস কর্মকর্তা অফিসে যাচ্ছেন না। মূলহোতার সহযোগী মাউশির উচ্চমান সহকারী বেলাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কলেজ শিক্ষক ও মাউশির কর্মচারীসহ এখন পর্যন্ত ৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা জালে রয়েছে মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরও অন্তত ৬ জন। যারা মাউশির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, বদলি ও তদবির চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পুলিশ জানিয়েছে, পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবিব ও অফিস সহকারী নওশাদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এদিকে, গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী শিক্ষা সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীকের সঙ্গে বৈঠক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপি) একটি প্রতিনিধি দল। অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান একেএম হাফিজ আক্তারের নেতৃত্বে একটি দল প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। কোনো ছাড় না দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
মাউশির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি এখন স্পষ্ট। তাই ঘটনায় ১ লাখ ৮৩ হাজার চাকরি প্রার্থীর অংশ নেওয়া নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করা হচ্ছে। পরীক্ষা বাতিল করে দ্রুতই মাউশি একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে।
মাউশির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএসএস শিক্ষা ক্যাডারের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র টিসার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ইডেন কলেজ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। ঘটনার দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রশ্নপত্র ইডেন কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ইডেন কলেজের একজন শিক্ষক, মাউশির উচ্চমান সহকারী বেলাল হোসেন ও দুজন আনসার সদস্য কেন্দ্রে যান। কিন্তু প্রশ্নপত্রের দায়িত্ব যে মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন তিনি অ্যাম্বুলেন্সে প্রশ্নের সঙ্গে যাননি। প্রশ্নপত্র নিরাপদে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার মূল দায়িত্বে থাকার পরও প্রশ্নপত্রের সঙ্গে তার না যাওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক হিসেবে দেখছেন পুলিশের তদন্তকারীরা। টিসার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রশ্নপত্র সিলগালা করা থেকে শুরু করে কেন্দ্রে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ফাঁসের পর ৭০টি প্রশ্নের উত্তর বের করে সারাদেশে চক্রের সদস্যদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পুলিশ বলছে, টিসার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ইডেন মহিলা কলেজে প্রশ্নপত্র নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। দায়িত্বে থাকা সবাইকে সন্দেহ করছে ডিবি। এর মধ্যে উচ্চমান সহকারী বেলাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে। প্রশ্ন ফাঁসের মূলহোতা হিসেবে মাউশির কলেজ শাখার একজন শিক্ষা কর্মকর্তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তিনি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় সব বিষয়ে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশিদ (সদ্য ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়া) বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের ব্যাপারে শিক্ষা সচিব ও মাউশিরর ডিজিকে (মহাপরিচালক) মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। যারা এ প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তারা যে কেউই হোক না কেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আমাদের গ্রেপ্তার অভিযান চলমান আছে।
পুলিশ বলছে, গত শুক্রবার ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ চাকরির পরীক্ষার্থী সুমন জোয়ার্দারকে গ্রেপ্তারের পর চক্রের আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পটুয়াখালীর খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে সুমনের কাছে প্রশ্নপত্রের উত্তর এসেছিল। সুমনকে সাইফুলের খোঁজ দিয়েছিল পটুখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মাউশির কর্মচারী আহসান হাবিব ও নওশাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ চক্রের আরও রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে আসছে। পুলিশ ধারাবাহিক অভিযানে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।