দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন দুটি পক্ষ (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) বিপরীতমুখী অবস্থানে তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যে সংকট সমাধানে সংলাপ হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়। অবশ্য একই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের কারণে সংলাপ হতে পারে বলে যে আশা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটাই নিরাশায় পরিণত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সংলাপের সম্ভাবনা এখনই উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
তারা মনে করছেন, সংকট সমাধানে সংলাপ এখন না হলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষকে এক টেবিলে বসতে হবে। বিএনপির সঙ্গে ‘সংলাপ’-এ বসার আগ্রহ জানানোর পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু তার বক্তব্য থেকে সরে আসেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংলাপ নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে তিনি তার কথায় অটল রয়েছেন। আর ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র ও দলটির সাধারণ সম্পাদক ‘আপাতত সংলাপ হচ্ছে না’ বলেও তিনি এমনটি বলেননি যে, সংলাপ কখনোই হবে না। গত শুক্রবার রাতে দলের মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে সংলাপ ইস্যুতে সাংবাদিকদের বলেন, আশার প্রদীপ এখনো নেভেনি। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সংলাপের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। আর সে কারণেই বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকট সমাধানে সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ এবং তার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সংলাপ বা আলোচনা না বসলেও দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি নানা উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে উভয় দল। মার্কিন নয়া ভিসানীতি ঘোষণার পর ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতের দপ্তরে গেছে সরকার ও বিরোধী পক্ষ।
এ ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং তৃতীয় পক্ষের উদ্যোগে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা চালাচালি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আর বিদেশি দূতাবাসের নানা উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলো যে সায় দিচ্ছে তা দৃশ্যমান। গত সপ্তাহে বলা যায়, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দূতাবাসে বৈঠক হয়েছে, আবার দূতাবাসের কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে গিয়েও বৈঠক করেছেন। গত সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুর সঙ্গে বৈঠকে করেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। ওই দিন দুপুরের দিকে গুলশানে বৈঠক করেন তারা। বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ মাসে অন্তত দুবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের নেতারা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় পক্ষই নির্বাচনের আগে রাজনীতি ও কূটনীতিতে তৎপর। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য প্রফেসর ড. আবদুল খালেক এ প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচনের আগে অনেক কিছুই হয়, অনেক নতুন নতুন কথাও শোনা যাবে। এটিই স্বাভাবিক।’
বিশিষ্ট নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক তেমন কোনো সাড়া মিলছে না। সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদও বিভিন্ন সময় সংকট সমাধানে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। কিন্তু এতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু বক্তৃতা দিতে গিয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার কথা বলার একদিন পর গত বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও সংলাপে বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের এই গুরুত্বপূর্ণ দুই দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যকে দুর্বল করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, সংলাপ নিয়ে আপাতত ভাবছে না তার দল। ওবায়দুল কাদেরের ওই বক্তৃতার একদিন পর অর্থাৎ শুক্রবার রাতে বলেছেন সংলাপ নিয়ে আশা শেষ হয়ে যায়নি। গত বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। তার ভাষ্য হচ্ছে— জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যেতে সংলাপ ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। অবশ্য দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সংলাপে বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট চাচ্ছেন। তারা বলছেন, একই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। সত্যিকারার্থে রাজনৈতিক সংকট সমাধান চাইল এ বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, ‘আমি মনে করি সংলাপ বা নো সংলাপ সেটি বড় কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে সদিচ্ছা। সদিচ্ছা হচ্ছে বড় জিনিস। আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সংলাপ করেন বা না করেন সদিচ্ছা যদি থাকে যে ‘দেশের শান্তি থাক, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, বিদ্বেষমুক্ত সমাজ থাকুক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা লালন হোক, তাহলে তো সবই সম্ভব, সবই অর্জন করা সম্ভব।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এখন সংলাপ বিষয়ে যেসব কথা হচ্ছে তার ভিত্তি যথেষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে একেকজন একেক কথা বলেন। ফলে এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য বা পরামর্শ দেয়ার সুযোগ নেই। ৮ জুন আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, সংলাপ, মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বা সংযোগ, কথা বলা, কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণ করা, কোনো বিষয়কে ক্রিটিক্যালি দেখা এগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার ক্ষেত্রে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে যেসব বিষয়গুলো আছে, যেগুলো বিষয়ে স্পষ্ট বিধিবিধান আছে, সেগুলো নিয়ে ‘নিরর্থক বিতর্ক’ তৈরি কাম্য নয়। একটি সভ্য সুন্দর সমাজে যেসব বিষয়গুলো কোনো ধরনের ঘাটতি ছাড়াই সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত এবং যেভাবে কোনো সভ্য দেশে গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হয়, সরকার গঠিত হয়, সেই নিরিখে যখন এসব বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়, তখন বুঝা যায় এর পেছনে নানা অনুসাঙ্গিক বিষয় সংযুক্তি থাকতে পারে। আর যেসব উদ্বুদ্ধ বিষয়ে যথেষ্ট আইনের কভারেজ থাকে না, সেসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা বা সংলাপ করে সুরাহা বের করা হচ্ছে উত্তম পন্থা।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট উত্তরণ প্রয়াসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা— একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। এতে অংশ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ও বিদ্যুতের দাবি থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্য সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। ‘নির্বাচন ইস্যুতে কাউকে আলোচনার জন্য আহ্বান করা হয়নি’ বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর দেয়া এ বক্তব্য প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, তারা একটি জিনিস ভালো পারে, সেটি হচ্ছে ডাইভার্সন। আমু সাহেব তো দলের মুখপাত্র নন। তার বক্তব্যের পরেই দলের মুখপাত্র (ওবায়দুল কাদের) বললেন, এটি তো আমাদের দলের বক্তব্য নয়। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। এদের একটিই উদ্দেশ্য… তা হলো মানুষের দৃষ্টি ডাইভার্ট করা। উদ্দেশ্য একটিই, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি ও বিদ্যুতের দাবিকে ডাইভার্ট করা। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আগে পদত্যাগ করুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। এর পরেরটা পরে দেখা যাবে। দেশের মানুষ সেটি বুঝবে। আমরা লড়াইয়ে নেমেছি… জাতি নেমেছে। লড়াই করছি জাতির অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য, বিএনপিকে ক্ষমতা আনার জন্য নয়। একই দিন একই ইস্যুতে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি বলেন, সংলাপের কথা শুনে বিএনপির নেতাদের আবারও জিহ্বায় পানি এসেছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে আপাতত আমরা ভাবছি না, ভাবব কি-না সেটি পরের বিষয়। গতবারের কথা আমাদের মনে আছে; এক বার নয়, দুই বার তাদের সঙ্গে সংলাপে বসেছি। রেজাল্ট কী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উত্তম পথ হচ্ছে আলাপ-আলোচনা করা। যারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমের সমাধানের বিপক্ষে তারা মূলত অপরাজনীতিকে উৎসাহিত করে। তিনি মনে করেন, দেশের স্বার্থে চলমান সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। এটিই উভয় পক্ষের জন্য মঙ্গল। দৈনিক আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।