চিকিৎসাসেবার প্রতি অনাস্থা থেকে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে প্রতি বছর কয়েক লাখ বাংলাদেশি রোগীরা যাচ্ছেন বিদেশে। দেশের চিকিৎসাসেবার অপ্রতুল অগ্রগতি, সময়ের সাথে বিশ্ব মানের আধুনিকায়ন চিকিৎসাসেবা না দিতে পারার কারণে রোগীদের বিদেশমুখী হচ্ছেন। এক দশক আগেও কেবল সমাজের বিত্তশালীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতেন। তবে এখন মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের অনেকেই একই পথের যাত্রী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রোগীরা ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, জাপান, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে যাচ্ছেন।
সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ও চার্নক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত শার্মা গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে ভারত। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। বছরে ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেডিকেল ট্যুরিস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাচ্ছেন।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশিরা এতে খরচ করছেন প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও প্রাইভেট হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, এ ব্যয়ের বাইরে রোগী ও স্বজনদের আসা-যাওয়া, থাকা, খাওয়া খরচ হিসাব করলে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর ভারত ছাড়া বিভিন্ন দেশে যারা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন তাদের ব্যয়সহ হিসাব করলে বছরে মোট ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া বেশির ভাগ রোগীই ভারতের কয়েকটি রাজ্য বেশি যাচ্ছেন। একটি বড় অংশ যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ, তামিল নাড়ু, দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাই। তা ছাড়া বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদসহ অন্যান্য রাজ্যে যাচ্ছেন কিছু সংখ্যক মানুষ। মেডিকেল ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রেও দেশটি অন্যান্য ভিসার চেয়ে বেশি প্রধান্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশমুখী হওয়ার কারণ জানতে এ প্রতিবেদক কথা বলেন বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ও বিদেশ থেকে সেবা নিয়ে ফিরে আসা কয়েকজনের সাথে। ভারতের ভিসা সেন্টারের সামনে তীব্র রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা গাজীপুর থেকে আসা আশিক রহমানের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে তার কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি দেশে মুটামুটি প্রথম সারির কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছেন। কিছু দিন ভালো থাকলেও আবার দেখা দেয় সমস্যা। ভারত থেকে একই চিকিৎসাসেবা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফেরা একজনের পরামর্শে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি হাসপাতালে যেতে ইচ্ছুক।
ভারতীয় ভিসা সেন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন মৌমিতা বিশ্বাস, সাথে আছেন তার মা। তিনি আমার সংবাদের এ প্রতিবেদককে বলেন, তার মা সিঁড়ি থেকে পড়ে মেরুদণ্ডে ব্যথা পেয়েছেন গত এপ্রিল মাসে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কিছু দিন। কিন্তু কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় দিল্লির একটি হাসপাতালে যেতে যাচ্ছেন তারা। ব্রেন ক্যান্সারে ভুগছেন আট বছর বয়সি শিশু সাবলিনা আলম। তার বাবা ইফতেখার আলম দাঁড়িয়েছেন ভিসা সেন্টারের সামনে লাইনে।
তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তার মেয়ের বয়স পাঁচ বছর থাকাকালীন সময়ে তার ব্রেন ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই সময়ে ভারতে কয়েক দফা থেরাপি ও চিকিৎসা নেয়ার পর গত দুই বছর মেয়েটি সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এ বছরের মাঝামাঝি থেকে তার আবারও অসুস্থতা দেখা দিয়েছে। তিনি দেশের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নত ও ভালো চিকিৎসা পেতে ব্যয় বেশি হবে এটি স্বাভাবিক। চিকিৎসায় তার মেয়ে সুস্থ হলেই তিনি সন্তুষ্ট। ভারতের পর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে যান সিঙ্গাপুর। ভারতের চেয়ে আট থেকে ১০ গুণ বেশি খরচে চিকিৎসাসেবা নিতে উন্নত দেশটিতে যাওয়া বেশির ভাগ মানুষই উচ্চবিত্ত শ্রেণির। দেশটি কয়েকবার গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়ে আসেন পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডের মিজান ট্রেডার্সের স্বত্ব্বাধিকারী ৫০ বছর বয়সি মিজান মোহাম্মদ।
তিনি জানান তার চিকিৎসার অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাম পায়ের হাঁটুতে ব্যথা পান। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেননি দীর্ঘদিন। দেশের প্রায় সব নামি-দামি হাসপাতালে ঘুরেছেন। এক সময় তাকে বলাও হয়েছিল তিনি আর কখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবেন না। তার এক নিকটাত্মীয়ের পরামর্শে সিঙ্গাপুরে হাড়ের উন্নত চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর গত তিনি বছরে তিনি আটবার সিঙ্গাপুর গিয়ে হাঁটুর চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন। তিনি এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটাসহ দৈনন্দিন সব কাজ করতে পারেন। তিনি আরও জানান, দেশের চিকিৎসার প্রতি তার আস্থা অনেকাংশে কমে গেছে। এক মাসের বেশি সময় থাইল্যান্ডে নিজের স্ত্রীর জটিল রোগের চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
তিনি দেশের চিকিৎসাসেবা ও বিদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে বলেন, ‘থাইল্যান্ডে তিনি তার স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার মনে হয়েছে তিনি দেশে অর্থ অপচয় করেছেন। দেশে তার স্ত্রীর রোগকে যতটা জটিলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল রোগটি এতটা জটিল ছিল না। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসাসেবা পেয়েছে আমার স্ত্রী। সে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। ব্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আপনার সামর্থ্য থাকলে আপনি ভালো সেবা পেতে সব সময়ই অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকবেন। কিন্তু অর্থ ব্যয় করে সঠিক সেবা না পেলে আপনার অর্থ ও সময় দুটোই অপচয় হবে।’
রোগীদের বিদেশমুখী হওয়ার কারণ সম্পর্কে ডাক্তারদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘দেশের মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাচ্ছে এমন সংখ্যা কম নয়। এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই তার পার্শ্ববর্তী দেশে চিকিৎসা করানোর জন্য মানুষ গিয়ে থাকে। যেসব রোগের চিকিৎসা দেশেই করা সম্ভব এমন রোগের চিকিৎসা করার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া মানে হলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করা। কিছু জটিল রোগ আছে যেসব রোগের চিকিৎসা আমাদের এখানে করাতে গেলে জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয় বা দেশে এসব চিকিৎসা প্রসারিত হয়নি। সে সব রোগের চিকিৎসা নিতে মানুষ যেতে পারে। তবে হুজুগের বশে কেউ দেশে চিকিৎসা থাকলে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই দেশের ডাক্তাররা যথেষ্ট পরিশ্রমী ও মেধাবী। আমাদের দেশেই ভালো চিকিৎসা হয়।’
দেশের স্বাস্থ্য খাতে আশানুরূপ উন্নয়ন না হওয়ায় বিদেশমুখী হচ্ছে মানুষ। এতে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা বাইরে ব্যয় হচ্ছে। অর্থনীতির উপর এ ব্যয়ের প্রভাবের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদের সাথে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘দেশের চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও মানুষ চিকিৎসা করাতে বিদেশ যাচ্ছে। আমাদের রিজার্ভ সংকট দেখা যাচ্ছে। আমরা বিদেশ গিয়ে ডলার খরচ করছি। করোনাকালীন সময়ে মানুষ বিদেশমুখী ছিল কম তখন রিজার্ভ বেড়েছিল। দেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ দেশের চিকিৎসাসেবা চাহিদা অনুসারে উন্নত হয়নি। স্বাস্থ্যসেবা গতানুগতিক ধারায় চলছে। দেশের বাইরে কেন মানুষ চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারলে মানুষ চিকিৎসা নিতে বাইরে যেতেই থাকবে। দেশে অর্থ বাইরে ব্যয় হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তা ছাড়া আমাদের এখানে একটি শ্রেণি যখন বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায় তারা এমন ঘটা করে যায়— এতে অন্যরাও বিদেশে চিকিৎসা নিতে উৎসাহ পায়।’
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের চিকিৎসাসেবা মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নত ও আধুনিকায়ন না হওয়ার কারণ জানতে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিমের সাথে। তিনি বলেন, ‘দেশে যতগুলো সরকার এসেছে কেউ জণগণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে কাজ করেনি। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশে চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন হয়নি। তাই মানুষ বিদেশমুখী হচ্ছে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে জনগণকে তার মৌলিক অধিকার চিকিৎসাসেবা রাষ্ট্র থেকে বুঝে নিতে হবে।’