মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষ কর্মী নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে শিক্ষাসনদ ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। এসব নিয়োগের বিচার চেয়ে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৩ জনকে নোটিস (নোটিস ডিমান্ডিং জাস্টিস) পাঠিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান খান। ওই নোটিসও আমলে নেয়নি বাপেক্স।
এর আগে বাপেক্সের রূপকল্প-৩-এর পিডি (প্রকল্প পরিচালক), ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ প্রকল্পের পিডি, দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের পিডি, রূপকল্প-১-এর প্রকল্প পরিচালক, রূপকল্প-২-এর প্রকল্প পরিচালক, রূপকল্প-৪-এর প্রকল্প পরিচালক, ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের (ব্লক-৩ বি, ৬-বি ও ৭) প্রকল্প পরিচালক ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ সরঞ্জাম ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালকের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শেষ করেছে। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে রূপকল্প-৫-এর পিডি ও রূপকল্প-৯-এর পিডির বিরুদ্ধেও বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
এতে প্রাথমিকভাবে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মেলেছে বাকেক্সের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। তাদের বেশির ভাগ বাপেক্সের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) পদে কর্মরত ছিলেন। সে সময় নানাভাবে তারা প্রকল্পের টাকা লোপাট, ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিনা টেন্ডারে বারবার একই কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এ ছাড়া লোক নিয়োগ ও স্থায়ীকরণে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে। নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাসনদ ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ। এসব নিয়োগে বড় ধরনের অর্থ-বাণিজ্য হয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এবার বাপেক্সের বিভিন্ন পদে ৫৪ জনের নিয়োগ ও চাকরি স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নানা ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা, নকল অভিজ্ঞতা সনদধারীদের প্রধান্য, জেলা কোটার অজুহাতসহ নানা কারণে যোগ্যদের বাদ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। অনিয়মে বাড়তি সুবিধা আদায়ে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বাপেক্সের প্রভাবশালীদের পোষ্য ও আত্মীয়স্বজনকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাপেক্স সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ৫৪ জনকে নিয়োগের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন খোদ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। জ্বালানি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, অস্থায়ী জনবল থেকে অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দিয়ে তারপর বাকিদের নিয়োগ দেয়া হোক। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ওই নির্দেশনা মানছে না বাপেক্সের নিয়োগ শাখা।
এর আগে গত পাঁচ বছরে চার দফায় নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। পদ স্থায়ীকরণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়, উচ্চ আদালত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগে অবশ্যই রাজস্বভুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তাদের অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিবারই এ নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান সংশ্লিষ্টরা। উল্টো নিয়োগ পাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন আর অদক্ষরা। কারণ, নতুন নিয়োগ বা স্থায়ীকরণ মানেই নানা ধরনের অনৈতিক বিষয়ের যোগসাজশ। এ ধরনের ঘটনার পর প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্টও জমা পড়ে। কিন্তু কিছু দিন পর গায়েব হয়ে যায় তদন্ত রিপোর্ট।
সূত্র জানায়, পাঁচ বছরে শুধু নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে বাপেক্সে চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মামলাও হয়েছে একাধিক। এখনো আদালত অবমাননার একটি মামলা চলমান। চারটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সব তদন্ত রিপোর্টে। একটি রিপোর্টে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি, বিভাগীয় মামলা, অডিট করানো, এমনকি নিয়োগকৃতরা যত বেতন-ভাতা পেয়েছেন, সব টাকা ফেরত দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্টও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। যারা নিয়োগ দিয়েছেন এবং যারা নিয়োগ পেয়েছেন, এমন অভিযুক্ত কারো বিরুদ্ধেই এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে ১৪২ জন, ২০১৮ সালে ছয়জন, ২০১৯ সালে ৮৫ জন এবং ২০২২ সালে ৩৩ জন কর্মীকে নিয়োগ প্রদান ও স্থায়ীকরণেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। প্রতিটি অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলাও গড়িয়েছে। অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বর্তমানে আদালত অবমাননার মামলাও চলমান। সমপ্রতি ৫৪ জনের নিয়োগেও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অস্থায়ী কর্মচারীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেয়ার বিষয়টিও আমলে নেয়া হচ্ছে না।
এদিকে ২০২১ সালে নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে অস্থায়ীভাবে ৮৫ জনসহ বিভিন্ন সময়ে পাঁচ শতাধিক লোকবল নিয়োগ দেয়ার পর তাদের স্থায়ীকরণ করা হয়। যেখানে শতাধিক জনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও বিভিন্ন সময়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা হওয়া সংশ্লিষ্টদের অভিযোগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানা যায়, লোক নিয়োগে দুর্নীতির সূত্রপাত শুরু ১৪২ জন কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে। এ ছাড়া অস্থায়ী নিয়োগ পাওয়া ৮৫ কর্মচারীকে স্থায়ী করতে গিয়েও বড় ধরনের কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। এদিকে উল্লিখিত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর চিঠি দিয়েছে কর্মচারীদের একটি গ্রুপ। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব জানান, কোনো ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। বর্তমান অভিযোগগুলো পুরোনো, তার আমলে হয়নি। তার যোগদানের পর যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠে, তাহলে সেগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।