ব্যাংক খাতে আন্তঃব্যাংকের বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে লেনদেনের অঙ্ক কমে গেছে। নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে লেনদেন কমেছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট ও দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রতি সবল ব্যাংকগুলোর আস্থাহীনতার কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। এতে ব্যাংকগুলোতে গড়ে বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। আন্তঃব্যাংকে চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান না পেয়ে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতা ধার করছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো নিয়মিতভাবেই জরুরি প্রয়োজনে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ধার করে। এর মধ্যে কলমানিতে ধার করে একদিনের জন্য। ছয় থেকে ১৪ দিনের জন্য ধার করে স্বল্পমেয়াদি নোটিশ হিসাবে এবং মেয়াদি ধার করে ৯১ দিনের জন্য। বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষ করে যাদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ রয়েছে তারা ধার দেয় এবং যাদের জরুরি প্রয়োজনে অর্থের প্রয়োজন বা তারল্য সংকট রয়েছে তারা ধার করে। নিয়ম অনুযায়ী এসব উপকরণে ধার করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুদসহ ফেরত দিতে হয়। ফেরক না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সাধারণত এতে কোনো ব্যাংক দেনা শোধে ব্যর্থ হয় না। তারপরও বেশ কিছুদিন আগে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এসব উপকরণের মাধ্যমে ধার নিয়েও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত গড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের অঙ্ক কমে গেছে। বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে গত নভেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ৭ লাখ ১৯ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে এই লেনদেন কম হয়েছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এ খাতে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর লেনদেন কমেছে ৭৯ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। চেকের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি), রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)- এমন সব মাধ্যমে লেনদেন কমেছে।
আলোচ্য সময়ে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর লেনদেন কমেছে ৬৩ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। গত নভেম্বরে তারা আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করেছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে লেনদেন কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকায়।
একই সময়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংকে লেনদেন কমেছে ১৬ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। গত নভেম্বরে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ২৯২ কোটি টাকায়।
সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ার চেয়ে ঋণ বেড়েছে বেশি। বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে কম। এছাড়া ডলার সংকট মেটাতে নগদ টাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে অনেক ব্যাংক। এসব কারণে তারল্য সংকট বেড়েছে। যে জন্য আন্তঃব্যাংকে ধার দেওয়া ব্যাংকের সংখ্যা ও অর্থের অঙ্ক কমেছে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংককে এখন কোনো ব্যাংক ধার দিতে চাচ্ছে না। কারণ তাদের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে। এতে তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আন্তঃব্যাংকে প্রায় প্রতিদিনই আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এতে একদিনের জন্য কলমানিতে সুদের হার সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ শতাংশ। অন্যান্য খাতে সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ খাতে সুদের হার বাড়তে দেয় না। নানাভাবে চাপিয়ে রাখে। যে কারণে সুদের হার একটি সীমার মধ্যে থাকছে। তবে তারল্য সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক এ খাতে ধার চেয়েও পাচ্ছে না। আন্তঃব্যাংকে ধার না পেয়ে তারা চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ব্যাংকগুলোর আগে কেনা ট্রেজারি বিল পুনরায় বন্ধক রেখে রেপোর মাধ্যমে ঋণ নিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় তারল্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তারা একদিন, ৭ দিন ও ১৪ দিন মেয়াদি তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। এতে সুদের হার হচ্ছে ৮ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ। গত সোমবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপোর মাধ্যমে ধার দিয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। মঙ্গলবার আন্তঃবাংকে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা