জিন্নাতুন নূর
রাজধানী ঢাকার অনেক সড়কে দিনের আলোতেও কয়েক মিটার দূরে কী আছে তা এখন দেখা যাচ্ছে না। আর এমনটি হচ্ছে তীব্র ধুলোবালির কারণে। নগরজুড়ে ভাঙা সড়কগুলোর মাটি-বালু একাকার হয়ে তৈরি করছে ধোঁয়াটে এক পরিবেশ। সড়কের পাশে থাকা গাছপালা ও স্থাপনায় পড়েছে ধুলোর পুরু স্তর। পুরো নগরজুড়েই এখন ভয়ংকর রকম বায়ুদূষণ ঘটছে। কয়েক বছর আগেও ঢাকার বায়ুর মান খারাপ ছিল কিন্তু এখন বায়ুদূষণ অতীতের সব মাত্রা অতিক্রম করে ধূলিদূষণে রূপ নিচ্ছে। অথচ এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে নগরবাসী এর কোনো সুফল পাচ্ছেন না।
সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার ডট কম-এর বায়ুর মান নির্ণয়ে গতকাল (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। আর সূচক অনুযায়ী এ দিন ঢাকার বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যে, ২০২০ সালে বিশ্বে বায়ু দূষণের কারণে সবচেয়ে দূষিত শহর ছিল ঢাকা। আবার পরিবেশ অধিদফতরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্টের প্রতিদিনের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী ঢাকায় ১২ ডিসেম্বরের বায়ুর মান ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। নগরজুড়ে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, উড়ালসেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ চলছে জোরেশোরে। একদিকে হচ্ছে উন্নয়ন আর অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ। এসব অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত বালু, সিমেন্টসহ অন্যান্য সামগ্রী সড়কের ওপর যত্রতত্র পড়ে আছে। আবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য মাটি ও ধুলোবালিতে নির্মাণস্থলের আশপাশের এলাকা ধুলোয় ঢাকা পড়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধ করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতরের একার নয়। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারাই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী তাদের সবাইকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ জন্য সরকারি বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থাকে নিয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কীভাবে এবং কেন বায়ুদূষণ হচ্ছে তা চিহ্নিত করে এই কমিটির উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু এর পরও এখন পর্যন্ত বায়ুদূষণের অবস্থা অপরিবর্তিত আছে। কমিটি গঠনের পরও কেন বায়ুদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না তা জানতে আগামী সপ্তাহে একটি আন্তমন্ত্রনালয় বৈঠক হওয়ার কথাও রয়েছে। ইটভাটাগুলোয় ইট পোড়ানোর কাজ শুরু হওয়ার মৌসুম এলেও চলতি বছর বৃষ্টির কারণে কিছুটা দেরিতে এগুলো শুরু হচ্ছে। কিন্তু ইটভাটাগুলো চালুর আগেই ঢাকার বায়ুমানের যে অবস্থা, এগুলো চালুর পর অবস্থা আরও খারাপ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। গত বছর পরিবেশ অধিদফতরের অভিযানে ঢাকার আশপাশে প্রায় ৫০০টি ইটভাটা ভেঙে ফেলা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবছর দেশে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ইট ব্যবহার হয়। এর প্রায় ৪০ ভাগই সরকারি কাজে ব্যবহৃত। এই পরিমাণ ইটের বদলে যদি পরিবেশসম্মত ব্লক ব্যবহার করা যায় তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমে যাবে বলে পরিবেশবাদীরা মনে করেন। পরিবেশ অধিদফতরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে, ঢাকার বায়ুদূষণের মূল কারণগুলো হচ্ছে অতিরিক্ত যানবাহন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া, বাড়িঘর নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী থেকে সৃষ্ট ধুলোবালি, শহরের বড় বড় স্থাপনা নির্মাণের ফলে সৃষ্ট ধুলোবালি, ভোরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের রাস্তার কোণে ফেলে রাখা ময়লা। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের দূষিত বায়ু বাতাসের মাধ্যমে উড়ে এসে দেশে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে বলে জানা যায়। নিয়ম অনুযায়ী রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করা হলে কাজ শেষে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নিতে বা ঢেকে ফেলতে হবে। কিন্তু একবার কোনো নির্মাণ কাজ শুরু হলে বা খোঁড়াখুঁড়ি করা হলে তা সহজে সরিয়ে নিতে দেখা যায় না। আবার সরকারি বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থা নানা সময় রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলে এর ফলে যে ধুলোবালি সৃষ্টি হয়, তা রোধ করতে কার্যকর ভূমিকা সেই সংস্থার লোকজন রাখেন না। ঘরবাড়ি নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইট-বালু সড়কের ওপর যাতে পড়ে না থাকে তা তদারকির দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। কিন্তু সংশ্লিষ্ট এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না। নগর বিশ্লেষক স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই আমরা যুগপৎভাবে অনেক মহাযজ্ঞ চালাচ্ছি। একই রকমভাবে আমাদের ইটের ভাটার যে কার্যক্রম তা থেকে সরে আসার যত অঙ্গীকার এবং কৌশল সব কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লক ঢোকানোর চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে ভেবেছিলাম সরকারি প্রকল্পগুলোয় এই কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার হবে। এতে ইটের চাহিদা কমে যাবে। এর মাধ্যমে ইটভাটার সঙ্গে জড়িত শক্তিশালী চক্রের উদ্যোগেও ভাটা পড়বে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শুধু একটি নেক্সাস তৈরি করার মধ্য দিয়ে ইটের বিকল্প ব্যবহারকে বাস্তবায়ন করা যায়নি। পুরো নগরজুড়ে গণপরিবহন ব্যবস্থার শিফটিংয়ের মধ্য দিয়ে যে বিরাট বায়ুদূষণ রোধ করতে পারতাম তা-ও সম্ভব হচ্ছে না। বরং ব্যাপক হারে প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দিয়ে পুরো নগরীকে যানজটের নগরীতে পরিণত করা হয়েছে।’