অবশেষে ঝিমিয়ে পড়া তৃণমূলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের গতি ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে জেলা শহরের তৃণমূল পর্যায়ের সকল শাখাকে চিঠি দিয়েছে দলটি। একই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন কোন্দলের পেছনে যেসব রহস্য রয়েছে তাও খোঁজ নেয়াসহ বিদ্যমান সাংগঠনিক সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করতে ‘সাংগঠনিক টিম’ গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত ১০ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। তবে সেই চিঠির মধ্য দিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সমস্যার কথা উন্মোচন হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা দেখছেন অন্যভাবে। তারা বলেন, সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটা দলের জন্য সুনির্দিষ্ট পরামর্শ বলে দাবি করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
তৃণমূলে পাঠানো চিঠি সূত্রে জানা যায়, তৃণমূল সংগঠনে সারা দেশে সকল জেলা, মহানগর শাখার অধীন উপজেলা, থানা, পৌর শাখা আওয়ামী লীগের গতিশীলতা বৃদ্ধি করা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমকে আরো জোরদার করার লক্ষ্যে জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ‘সাংগঠনিক টিম’ গঠন করতে হবে।
nagad
উক্ত ‘সাংগঠনিক টিম’ সংশ্লিষ্ট জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা, থানা, পৌর শাখার বিদ্যমান সাংগঠনিক সমস্যাসমূহ দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। একইভাবে উপজেলা, থানা, পৌর শাখার অধীনের ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিট শাখার বিদ্যমান সাংগঠনিক সমস্যাসমূহ দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
জানা যায়, দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে সফল হলেও উল্টোচিত্র দেখা দিয়েছে দলটির তৃণমূলে। বিশেষ করে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সংসদ সদস্যপন্থিদের সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং হামলা-মামলা দিন দিন বাড়ছেই। তৈরি হচ্ছে ভাই লীগ, এমপি লীগ। কোনো কোনো জেলা শহরে এসব দ্বন্দ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। অনেকেই নিজ নিজ বলয় ও ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এসব বিষয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বলেন, এমপি ও এমপিপন্থি দলের নেতা-কর্মীরা দলের সাংগঠনিক নিয়মনীতি ও গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না।
ইতোমধ্যে এসব বিষয় নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলোচনা চলছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছেও বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। যার ফলে আওয়ামী লীগকে ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগের বলয় থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা কাজ শুরু করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসব কার্যক্রম নিয়ে তৎপর হয়ে উঠছেন। এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা। তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির কতিপয় নেতারা হস্তক্ষেপ না করলে ‘ভাই লীগ ও এমপি লীগ’ থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাবে বলে মনে করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, শুধু এমপি লীগ কিংবা ভাই লীগ নয়, উপজেলা, ওয়ার্ড এবং ইউনিট কমিটির সঙ্গে জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দেরও কোন্দল চলছে। সেই কোন্দলের কারণে অনেক উপজেলা কমিটির মেয়াদ দীর্ঘ দিন হলেও সম্মেলন হচ্ছে না। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে অহরহ দ্বণ্দ্ব চলছেই। দেশের বেশিরভাগ জেলা-উপজেলার ক্ষেত্রে একই চিত্র। সংগঠনের মধ্যে কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লোকজন। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে দলের অভ্যন্তরে জামায়াত-বিএনপির নেতা-কর্মীরাও অনুপ্রবেশ করছেন। বিভিন্ন সময়ে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অদ্যাবধি সেই তালিকা হয়নি। এ নিয়েও তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে নানা ক্ষোভ, দ্ব›দ্ব ও বিভাজন।
২০১৭ সালে আওয়ামী লীগে ‘কাউয়া (কাক) ঢুকেছে’ বলে দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্তব্য করেছিলেন। তার এমন বক্তব্যের পর সারা দেশে দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছিল। বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন উঠেছে দলের ভেতরে কাউয়া কারা? সামাজিক গণমাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে নানা কথাবার্তা। জেলা শহরের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিডদেরকেই ‘কাউয়া’ বলতে শুরু করেছেন। তারপর বহুবার ‘কাউয়া’দের চিহ্নিত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা প্রকাশ পায়নি।
বর্তমানে সেই ‘কাউয়া’রা ত্যাগীদের বাদ দিয়ে তৃণমূল রাজত্ব করতে চায় বলেও জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী নেতা। তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন। তারাও বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ ধরনের গ্রæপ যাতে না হতে পারে ইতোমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সেই নির্দেশনা দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
সূত্রে আরো জানা যায়, ক্ষমতাসীন টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল আওয়ামী লীগের এক প্রকার বলয় সৃষ্টি হয়েছে। তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি ও তার ছত্রছায়ায় থাকা ভাই লীগরা। ‘এমপি লীগ ও ভাইলীগে’র কারণে তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মী দল থেকে অনেকই বঞ্চিত হয়েছেন। এমন কী স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দু’ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া কমিটি গঠন নিয়ে তো প্রতিনিয়ত সংঘর্ষের ঘটনা আছেই। তার মধ্যে দেশজুড়ে আলোচনায় রয়েছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট নির্বাচন। সেখানে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ঝাঁকুনি দিয়েছিল সেই কোন্দল। রাজনৈতিক কোন্দল থাকলেও দলের ত্যাগীরা মনে করছেন অন্য কিছু।
তারা বলছেন- দেশের রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। রাজনীতি চলে গেছে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের হাতে। যার কারণে তৃণমূলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে ভাটা পরেছে। সামান্য তুচ্ছ বিষয় নিয়েও হামলা-মামলা জড়াচ্ছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। সেই থেকে তৃণমূলকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। গত ১০ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একটি চিঠি দিয়েছেন তৃণমূলকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মানবকণ্ঠকে বলেছেন, ‘জেলা শহরের নেতারা এককভাবেই এতদিন কাজটা করতেন। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের জন্য একটা টিম করে দিলে জেলা কমিটির জন্য সাবলীল হয়। অনেকেই যেমন কমিটিতে আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের জন্য কাজ করেন না। সাংগঠনিক নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কেউ কাজ করবেন না। নিয়মনীতির মধ্যে কাজ করবেন।’
তিনি বলেন, বর্তমানে দলের মুখ্য বিষয় হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে দলেকে শক্তিশালী করা। এসব বিষয়ে যদি জটিলতা সৃষ্টি হয় তখনই তো গঠনতন্ত্রের বিষয় আসবে। এই চিঠির উদ্দেশ্য ভালো। এগুলো দেয়া হচ্ছে নেত্রীর নির্দেশনা বা পরামর্শক্রমে। সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য আমাদের নেত্রীর সুনির্দিষ্ট পরামর্শ থাকে। নেত্রী যে নির্দেশনা দেবেন সেভাবেই সাংগঠনিকভাবে দলকে সাজানো হবে।
এ বিষয়টি নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘তৃণমূল নিয়ে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু’ হয়েছে। কেন্দ্রের যেমন আট বিভাগের জন্য ‘সাংগঠনিক টিম’ রয়েছে ঠিক সেভাবে প্রতি জেলা-মহানগরের অধীনের সকল উপজেলা ও থানার জন্য ‘সাংগঠনিক টিম’ এবং উপজেলার সকল ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিটের জন্য ‘সাংগঠনিক টিম’ গঠন করবে। সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার করার জন্যই এই উদ্যোগ।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘এটা তো আমি আগে থেকেই করেছি। আমি প্রতিটি জেলাকে বলেছি, উপজেলাকে ঘিরে জেলা থেকে একটা টিম- সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অন্যান্য সদস্যদের দিয়ে প্রতিটি উপজেলা বা দুই তিনটি উপজেলা মিলে একটি টিম গঠন করার জন্য বলেছিলাম। কোথায় কী সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করে জেলাকে রিপোর্ট করবেন তারা। জেলা আমাদের সাথে কথা বলবে। এতে সংগঠন গতিশীল হয়। এতদিন আমরা মৌখিক বলেছি, এখন দলের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এই চিঠিটা দিয়েছে। দলকে গতিশীল করার জন্য আমি মনে করি এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে।’