সাদ্দাম হোসেন ইমরান
দেশ থেকে অর্থ পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পেয়েছে আর্থিক খাত নিয়ে কাজ করা দুটি গোয়েন্দা সংস্থা। এটি হচ্ছে অনলাইনে জুয়া খেলার দেনা-পাওনা সমন্বয়ের মাধ্যমে। এ জন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কতিপয় গ্রাহককে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা একাধিক হিসাব ব্যবহার করে জুয়াড়িদের পক্ষে টাকা স্থানান্তর করতেন। একপর্যায়ে তা বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর হয়ে দেশ থেকে পাচার হয়ে যেত। এভাবে অনলাইনে জুয়া খেলার মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ ব্যাপারে সংস্থা দুটি আরও তদন্ত করছে।
এদিকে অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধে জুয়াকে মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসাবে গণ্য করার জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনটি প্রণীত হলে অনলাইনে জুয়ার অর্থ লেনদেনকারীদের এই আইনের আওতায় আনা হবে। অনলাইনে জুয়া বন্ধে বিএফআইইউ ও পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি গ্রুপও কাজ করছে।
সূত্র জানায়, জুয়াড়িদের কাছে অনলাইনে জুয়া খেলা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ কিছু অ্যাপ ডাউনলোড করে মোবাইল ফোনেই খেলা যাচ্ছে জুয়া। এর গণ্ডি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এসব অ্যাপের বিস্তার ঘটেছে। ফলে এর মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো দেশের সংশ্লিষ্ট একাধিক গ্রাহকের সঙ্গে অনলাইনে জুয়া খেলার সুযোগ রয়েছে। খেলা শেষে দেনা-পাওনার লেনদেন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এসব অর্থ একটি পর্যায়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে ঢুকে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফরমও ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব অর্থ দেশের বাইরে পাঠাতে হুন্ডি, স্বর্ণ, নগদ ডলারও ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বিটকয়েন ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া গেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্যাসিনোগুলোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কয়েনও (যেমন- প্লাটিনাম, সিলভার, গোল্ড, ম্যাগনেটিক কয়েন ইত্যাদি) বাংলাদেশে বেআইনিভাবে লেনদেন হচ্ছে। এগুলো অনলাইনেও লেনদেন হয়। ফলে এগুলোর মাধ্যমেও টাকা পাচার হচ্ছে।
৩১ মে বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানের সভাপতিত্বে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিষয়ক কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের প্রতিনিধি অনলাইনে জুয়ার পেমেন্টের ক্ষেত্রে বিকাশ ও নগদের গ্রাহকের সম্পৃক্ততার কথা জানান। একইসঙ্গে পেমেন্ট গেটওয়ে স্ক্রিল ও নেটেলারের মাধ্যমে পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে লেনদেনের বাধ্যবাধকতা আরোপের পরামর্শ দেন।
বিএফআইইউর এক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, অনলাইনে জুয়ার অর্থ দুটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কতিপয় গ্রাহকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তারা অনলাইনে জুয়া খেলার লেনদেন নিষ্পত্তি করতে একই হিসাবে ঘন ঘন বিভিন্ন হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ স্থানান্তরের একটি সীমা রয়েছে। তারা ওই সীমার মধ্যে থেকেই ছোট ছোট অঙ্কে টাকা স্থানান্তর করেছেন। পরে সেগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর হয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে।
সূত্র জানায়, অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য বিভিন্ন অ্যাপ রয়েছে। এর মধ্যে বিগ ফিশ ক্যাসিনো অ্যাপ, বেস্ট ক্যাসিনো অ্যাপ বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া আরও কিছু অ্যাপ রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে জুয়া খেলে প্রথমে পয়েন্ট ভাগাভাগি হচ্ছে। একপর্যায়ে অর্থও লেনদেন হচ্ছে। এর একটি অংশ বিটকয়েনের মাধ্যমেও হচ্ছে। পাশাপাশি সিলভার ও প্লাটিনাম কয়েনও ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রায় প্রথমে দেশীয় এজেন্টকে অর্থ পাঠালে তিনি ওইসব কয়েন অ্যাকাউন্টে যোগ করে দেন। ফলে জুয়া খেলার সুযোগ হয়।
অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রে যে কোনো পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশে স্ক্রিল ও নেটেলার গেটওয়ে ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মাধ্যমে লেনদেনের ক্ষেত্রে যে কোনো একটি ব্যাংকের হিসাব ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে অনলাইনে বৈদেশিক লেনদেন যে কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে হবে। সরাসরি করা যাবে না। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একটি দায়বদ্ধতা থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক লেনদেনের গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান পেপাল ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে কাজ শুরু করবে। ফলে দেশ থেকে যেমন বৈদেশিক দেনা সহজে পরিশোধ করা যাবে, তেমনি বিদেশ থেকে অর্থও সহজে দেশে আনা যাবে। একই সঙ্গে প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড থাকবে। ফলে অনলাইনে টাকা পাচার ঠেকানো সম্ভব হবে। এছাড়া বিএফআইইউ আর্থিক খাতের সব গ্রাহকদের পরিচিতি বা কেওয়াইসি ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি হলে যে কোনো লেনদেনের হিসাবধারীকে সহজে শনাক্ত করা যাবে। তদন্ত কাজও দ্রুত এগোবে।
অনলাইনে জুয়ার সাইট চালানোয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৭ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ৬ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি পুলিশ। এ ঘটনায় পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।