নিজস্ব প্রতিবেদক
জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত ফয়সাল করিম মাসুদের বিষয়ে নতুন করে একাধিক তথ্য সামনে এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, ফয়সাল করিম মাসুদ অতীতে শোবিজ অঙ্গনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি তার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব বিশ্লেষণে বিপুল অঙ্কের অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ফয়সাল করিম মাসুদ ২০২২ সালে নির্মিত ‘কিলার’ শিরোনামের একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সম্প্রতি ওই নাটকে তার অভিনয়ের কয়েকটি স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযুক্তের অতীত গতিবিধি ও পরিচিতি যাচাইয়ের অংশ হিসেবে তার পেশাগত ও সামাজিক সংযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের আর্থিক দিক অনুসন্ধানে সিআইডি জানায়, ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে ১২৭ কোটি টাকার বেশি অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। রোববার (২১ ডিসেম্বর) এক লিখিত বিজ্ঞপ্তিতে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবু তালেব এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয় করে আর্থিক লেনদেনের একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ সম্পন্ন করা হয়েছে। ওই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী ফয়সাল করিম মাসুদসহ তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচার সংক্রান্ত পৃথক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডি।
সিআইডি জানায়, অভিযুক্ত এখনো গ্রেপ্তার না হলেও মামলার আলামত গোপন এবং তাকে পালাতে সহায়তার অভিযোগে তার পরিবারের সদস্যসহ একাধিক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব অভিযানে বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক চেকবই উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া চেকবইগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেগুলোতে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থের উল্লেখ রয়েছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত লেনদেন সম্পন্ন হয়নি। এসব অসম্পূর্ণ লেনদেনের সমষ্টিগত পরিমাণ প্রায় ২১৮ কোটি টাকা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাস্তবে সংঘটিত লেনদেনের মধ্যে ১২৭ কোটি টাকার বেশি অর্থ স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, এসব লেনদেন মানি লন্ডারিং, সংঘবদ্ধ অপরাধ কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। বিষয়টি যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবু তালেব জানান, অভিযুক্ত ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা প্রায় ৬৫ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে এসব অর্থের মূল উৎস এবং সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করার জন্য অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।
সিআইডি সূত্র আরও জানায়, শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো সংঘবদ্ধ বা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক জড়িত ছিল কি না, সে বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং অস্ত্র সরবরাহের সম্ভাব্য যোগসূত্র খতিয়ে দেখতে একাধিক তদন্ত দল মাঠে কাজ করছে। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে মূল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার এবং পুরো অপরাধচক্র উন্মোচনের লক্ষ্যে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোড এলাকায় শরিফ ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর তাকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির নিকটবর্তী স্থানে তাকে দাফন করা হয়।