মেহেদী হাসান
ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মৃত্যুর পর মাসে ৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি ও মাদকের হাট দখলে নিতে মাঠে নেমেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১০টি গ্রুপ। এর মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
প্রশাসনের নাকের ডগায় এলাকায় বেড়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আনাগোনাও। এ কারণে যে কোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা। ঢাকার মিরপুর, শাহআলী ও দারুস সালাম থানা, রূপনগর থানার আংশিক এবং সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-১৪ আসন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড এ আসনের অন্তর্ভুক্ত। জানা গেছে, বিভিন্ন খাতে দিনে ২ কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। আগে এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হকের পরিবার। এলাকায় তাদের অনুগত নেতারা চাঁদা তুলতেন এবং সংসদ সদস্য ও তার পরিবারের লোকদের কাছে চাঁদার টাকা পৌঁছে দিয়ে নিজেরা কমিশন পেতেন। গত ১৪ এপ্রিল আসলামুল হকের মৃত্যুর পর চাঁদা আদায়কারী নেতারা হঠাৎ বদলে গেছেন। আসলাম পরিবারকে দেওয়ার বদলে নিজেরাই এখন চাঁদার শতভাগ নিচ্ছেন। বর্তমানে এমন গ্রুপের সংখ্যা ছয়টি। আবার এত দিনে যারা আসলামবিরোধী ছিলেন, চাঁদার বাণিজ্য দখলে নিতে মাঠে নেমেছেন তারাও। চারটি এই ধরনের গ্রুপ এখন মাঠে সক্রিয়। অন্যদিকে চাঁদা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে রাজি নয় আসলাম পরিবার।
চাঁদাবাজির ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে—শাহ আলী মাজারের সামনে ও পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধ ঘেঁষে গড়ে তোলা কাঁচামালের আড়ৎ, বুড়িগঙ্গা তীরের কয়লাঘাট, পাথরঘাট, সিমেন্টঘাট, বালুঘাট ও সারঘাট; শাহ আলী মাজারের বিপণিবিতান, বেসরকারি স্কুল-কলেজ, গাবতলী পশুরহাট, একাধিক বাসস্ট্যান্ড, ট্রাক টার্মিনাল, টেম্পোস্ট্যান্ড ও ফুটপাতের দোকান, বড় বড় শপিং মল, মাদক ব্যবসা, বোটানিক্যাল গার্ডেন-মিরপুর চিড়িয়াখানার ইজারা প্রভৃতি। নৌপথেও চলছে চাঁদাবাজি। সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়ন ঢাকা-১৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত। কাউন্দিয়ায় যাওয়ার একমাত্র পথ নৌপথ।
একাধিক ব্যবসায়ী ইত্তেফাককে জানান, আসলামের মৃত্যুর পর থেকে একাধিক গ্রুপকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। সকালে দুই গ্রুপকে চাঁদা দিয়েছি, বিকালে এসেছে তিন গ্রুপ, সন্ধ্যায় চাঁদার টাকা পৌঁছে দিতে হয়েছে আরেক গ্রুপের বাসায়। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। এদিকে চিড়িয়াখানা এলাকা থেকে তুরাগ নদীর পদ্মপাড়ের বালুঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিদিন বসে মাদকের হাট। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদক সেখানে বেচাকেনা হয়।
এছাড়া মিরপুর-১০ নম্বর থেকে কিছুটা এগোলে হাতের ডানদিকে চওড়া রাস্তা। স্থানীয়ভাবে ক্যাম্পের গলি নামে পরিচিত। রাস্তার দুই পাশে ২০-২৫টা সুদৃশ্য বহুতল ভবন পেরিয়ে একটা ফটক। ফটকের একপাশে বাঙালি, অন্যপাশে বিহারিরা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই ফটকের দুই পাশে জমে ওঠে মাদকের বাজার। এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা বললেন, আগে ক্যাম্পের গলি-ঘুপচিতে ইয়াবার কেনাবেচা ছিল।
এখন বাজার বড় সড়কের ওপর। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক ফাঁকা রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি এসে চওড়া রাস্তার ওপরে সারি বেঁধে দাঁড়াচ্ছিল। এই চালকদের ‘স্বাগত’ জানাতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল কিশোর-তরুণরা। চালক এসে দাঁড়ালেই তারা ফটকের ওপাশ থেকে ইয়াবা এনে দিচ্ছিল। টাকা শোধ করে যাত্রীবিহীন এই বাহনগুলো যেভাবে এলাকায় ঢুকছিল, বেরিয়ে যাচ্ছিল সেই একই ভাবে। এটা মাদকের পাইকারি ব্যবসা। আর ক্যাম্পের ভেতরে চলে খুচরা কেনাকাটা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ও শাহ আলী মাজারকেন্দ্রিক স্থাপনা থেকে বেশি চাঁদার টাকা আদায় করা হয়। আসলাম পরিবারের সদস্যরা চাঁদার হাট নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া। তবে আরো ৯টি গ্রুপ হানা দিয়েছে।
শাহ আলী মাজারকেন্দ্রিক গড়ে তোলা কাঁচাবাজারের জায়গাটির মালিক শাহ আলী মাজার কর্তৃপক্ষ। এখানে ৫ হাজার দোকান রয়েছে। আড়তে যেসব বিক্রেতা মাল নিয়ে আসেন, তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয় আবার আড়তদারদের কাছ থেকেও চাঁদা নেওয়া হয়। দোকানভেদে চাঁদার পরিমাণ গড়ে ১ হাজার টাকা। সে হিসেবে এই একটি খাত থেকে চাঁদা ওঠে দিনে ৫০ লাখ টাকা। কয়লাঘাট, পাথরঘাট, সিমেন্টঘাট, বালুঘাট ও সারঘাটের প্রতিটি থেকে দিনে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হয়। চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে মিরপুর-২ নম্বর, ১ নম্বর, মাজার রোড, গাবতলীর সব লোকাল বাস ও এলাকার টেম্পো থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। ফুটপাতে প্রায় ১৫ হাজার দোকান বসানো হয়েছে। প্রতিদিন দোকান থেকে দিনে গড়ে ৫০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের এক শ্রেণির নেতা ডোবানালা ফুটপাত থেকে শুরু করে সরকারি জায়গা, কলেজের জমি, মুক্তিযোদ্ধাদের ভিটেমাটি, মিরপুর মাজারের জায়গা দখল করে রেখেছেন। আনসার ক্যাম্প-সংলগ্ন গণপূর্তের পুকুর ভরাট, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান-সংলগ্ন তিন একর জলাশয় ভরাট, দারুসসালাম থানার (নতুন জায়গা) পাশে ১৫ কাঠা জমি দখল, মাজার রোডের মাথায় বাতেন নগরের ‘গাবতলী মাঠ’ দখলসহ একাধিক জমি আয়ত্তে নিয়েছেন তারা। ২০১২ সালে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের তিন বিঘা জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে রিট আবেদন করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের সীমানা দেওয়ালের দক্ষিণ ও কমিউনিটি সেন্টারের পশ্চিম পাশে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থার ২৩ একর জমি দখল করা হয়েছে। নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই জমি ২০০০ সালের ২৩ মার্চ সরকারের কাছ থেকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা (লিজ) নেয় মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা। সরকারি বাঙলা কলেজের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী আমিনুল ইসলামের ৩৭ শতাংশ জমি দখল করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৪-এ ঠিকাদারির পুরোটা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের এক শ্রেণির নেতার কবজায়। তারা মিরপুর অঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ সব ধরনের উন্নয়ন কাজের দরপত্র ভাগিয়ে নিচ্ছে প্রভাব খাটিয়ে। তাদের ভয়ে সাধারণ ঠিকাদাররা দরপত্র দাখিলেরও সাহস পান না।