নিজস্ব প্রতিবেদকভারতে এক বাংলাদেশি তরুণীর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে র্যাব আন্তর্জাতিক নারী পাচারের ভয়ংকর চক্রের সন্ধান পেয়েছে। গ্রেফতার করেছে চক্রের অন্যতম হোতা আশরাফুল ইসলাম রাফি ওরফে বস রাফি ও তার সহযোগী ম্যাডাম সাহিদাসহ চার সদস্যকে। অন্য দুজন হলো ইসমাইল সরদার, আবদুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ। এরা চারজন মিলে গড়ে তুলেছে ভয়ংকর এক পাচার চক্র। এ চক্রটি ভারতে নারী পাচার করে তাদের যৌন ব্যবসায় বাধ্য করত।
গত সোমবার রাতে যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোলে অভিযান চালিয়ে র্যাব তাদের গ্রেফতার করে। র্যাব জানিয়েছে, এরা ভারতে ৫ শতাধিক নারীকে পাচার করেছে। প্রতিজনের জন্য এরা নিয়েছে ৩০ হাজার টাকা। বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি তরুণীর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতরা এ চক্রের সদস্য। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নিয়ার্তনকারী টিকটক হৃদয়সহ অন্যরা এ চক্রের সদস্য।
নির্যাতনকারীদের সহযোগী হিসেবে এক তরুণীকে দেখা যায়। তার নাম তানিয়া। এ তানিয়া হলো ম্যাডাম সাহিদার মেয়ে।
গতকাল বিকালে কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কয়েকটি ধাপে নারী পাচারের কাজ করত চক্রটি। ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচার করত। প্রথমত, ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা যেমন- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। এরপর ভিকটিমকে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে রাখা হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদের সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখত। সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে প্রেরণ করা হতো। কলকাতা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো তাদের। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেফতার বস রাফি তাদের বিভিন্ন সেফ হাউসে রাখতেন। এরপর ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্ত ও অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হতো। সেফ হাউজগুলো থেকে তাদের ১০-১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে পাঠানো হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হতো। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেফতারকৃত রাফি এক সময় এ ধরনের পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। রাফি তামিল ভাষা রপ্ত করেছিল ফলে এক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতা ব্যাপক ভূমিকা রাখে। একপর্যায়ে সে লিডার হয়ে যায়। বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। গত আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার যাতায়াত। সে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার, রিসোর্ট কর্মচারী হিসেবে ও কাপড়ের ব্যবসা করত। গত পাঁচ বছর ধরে সে নারী পাচারে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয়। টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক তরুণীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে বস রাফি। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্য এজেন্ট রয়েছে। সম্প্রতি ভারতে এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই তরুণীকে ভারতে পাচার করে টিকটক হৃদয়। বস রাফি তাকে গত বছরের অক্টোবরে বেঙ্গালুরু নিয়ে সবুজের বাড়ির সেফ হাউসে রাখে। সেখানেই ভিডিওটি ধারণ করা হয় বলে জানা যায়। বেঙ্গালুরু বস রাফির বেশ কয়েকটি সেফ হাউস রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় তার সেফ হাউস রয়েছে। এর মধ্যে ম্যাডাম সাহিদার সেফ হাউস অন্যতম। বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার তিনবার বিয়ে হয়েছিল। সে এবং তার দুই মেয়ে যথাক্রমে সোনিয়া ও তানিয়া বর্ণিত পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরু অবস্থান করছে বলে গ্রেফতারকৃত সাহিদা জানায়। ভাইরালকৃত ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে। সাহিদা বাংলাদেশ এলাকায় একটি সেফ হাউস পরিচালনা করছে। সে এ ব্যবসায় দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জড়িত। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত ইসমাইল ও আবদুর রহমান শেখ বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করে থাকে। তারাও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত।