মাহবুব আলম লাবলু বৈধ আয়ের পথ ছাড়াই রাতারাতি বিত্তশালী বনে যাওয়া কয়েক হাজার মানুষ দেশের বড় আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এসব ধনীর বেপরোয়া দাপট সমাজের বিভিন্ন স্তরের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা। কারণ অধিকাংশ অপরাধ কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে থাকছেন তারা। হঠাৎ বিত্তশালীদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব বাগিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিও হচ্ছেন। ফলে সর্বত্রই শাসন-শোষণের মাধ্যমে নিজেদের ধনসম্পদ বাড়াতে মরিয়া তারা।
বিশ্লেষকদের আরও অভিমত, নব্য বিত্তশালীরা অর্থবিত্তের বেপরোয়া দাপটে সর্বত্রই প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টা করে থাকেন। গত এক দশকে মাদক, টেন্ডার, দলীয় প্রভাব, দখলবাজি, দালালি, তদবির ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই কয়েক হাজার মানুষ বিত্তশালী বনে গেছেন। বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথেই তারা বেশি টাকা কামিয়েছেন। এদের তালিকা তৈরি করে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশের শাসন প্রক্রিয়া ভেঙে গেছে। নিয়মনীতি কাজ করছে না। এ কারণে নব্য ধনীরা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হঠাৎ বিত্তশালীদের দেশের আপদ বলা যায়। এসবের পরিণতি শুভকর নয়। অবৈধ পথে যারা বিত্তশালী হচ্ছে তাদের সীমিতসংখ্যকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তারা সবাই চুনোপুঁটি। গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। ফরিদপুরের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ফরিদপুরে ডালপালা সব ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু গাছে হাওয়া লাগছে না। এটা করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস-বিআইডিএসের গবেষক নাজনীন আহমেদের মতে, উৎসহীন টাকার গরমে বিত্তশালী এই গোষ্ঠী সমাজ, দল ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে নিজেদের দাপট জানান দেন। সর্বত্রই অসম লড়াই চালানোর চেষ্টা করে। অবৈধ পথে যারা ৪০০-৫০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে তারা রাজনৈতিক প্রভাবে এগুলো করছে না। তারা এসব করছে ক্ষমতার প্রভাবে।
ক্ষমতা আছে বলেই তারা লোহার জায়গায় বাঁশ দিয়ে নির্মাণকাজ করে বিল তুলে নিচ্ছে। সমাজে দুর্নীতির ব্যাপকতা পেয়েছে। তবে তুলনামূলক ছোট ছোট দুর্নীতির উৎসমুখগুলোতে স্বচ্ছতা ফিরেছে। তবে বড় জায়গাগুলোতে স্বচ্ছতা আসেনি। এসব জায়গায় হাত দিতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্যই এটা করতে হবে। ক্ষমতার দাপট জিইয়ে রাখলে রাজনীতির জন্যও সেটি শুভকর হবে না।
আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেন, বরাবরই সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের আশীর্বাদেই এ ধরনের লুটপাট হয়ে থাকে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নেপথ্যে থাকেন আর রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্টরা সামনে থেকে এসব কাজ করেন। এখন যদি এ বিষয়টি তলিয়ে না দেখে শুধু সামনে থাকা ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয় তাহলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। যদি সদিচ্ছা নিয়ে ধরতে চাওয়া হয় তাহলে সবাইকেই ধরা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘যে কোনো অপরাধ যখন নিয়ন্ত্রণ হয় না তখন অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এখন সেটিই চলছে। আমরা অনেকটা আত্মঘাতী পথে হাঁটছি। দুর্নীতি দমন কমিশনের আসলে যে কাজ করা দরকার তারা আসলে সে কাজটি করতে পারছে না বা করছে না। এ কারণে সব ক্ষেত্রেই এদের প্রভাব বাড়ছে। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে শাহদীন মালিক বলেন, এই দুর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ও অবশ্যম্ভাবী পদক্ষেপ হলো ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন না দেওয়া। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি যেসব মন্ত্রী শপথ নেয়, সেখানে ১৩ জনের মধ্যে ৬ জন ছিলেন আইনজীবী। আর এ কারণেই তখন অনেক কিছু আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেনি।