বিশেষ সংবাদদাতাব্যক্তি পর্যায়ের ‘অর্থ পাচার’ নিয়ে এখন আগ্রহী হয়ে উঠলেও দেশের বহুল আলোচিত অর্থ পাচারের অভিযোগটি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো কাজই করেনি। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এটির ‘শেষ পরিণতি’ সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। গুঞ্জণ রয়েছে, অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাঘব বোয়ালদের বাঁচাতেই অনুসন্ধানটি নিয়ে আর নাড়াচাড়া পড়েনি। বর্তমান ব্যপকভিত্তিক অর্থ পাচারের তথ্য দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে। পানামা পেপার্স’র কেলেঙ্কারির সঠিক অনুসন্ধান হলে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে পরবর্তী বৃহৎ অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো ঘটত না। এক রহস্য বিববেরই ঢাকা পড়ে থাকল পানামা পেপার্সের ঘটনা। এমন অভিমত বিশ্লেষকদের।
দুদক সূত্র জানায়, একটি ‘যৌক্তিক পরিণতি’ উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঘটা করেই ‘পানামা পেপার্স’ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পাঁচ বছরে দৃশ্যমান হয়নি ওই ‘যৌক্তিক’ পরিণতি। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসায় কার্যত: বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বহুল আলোচিত এ অনুসন্ধানটি।
সূত্রমতে, ‘পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি’র বাংলাদেশ অংশটির কোনো অনুসন্ধানই হয়নি। ২০১৬ সালে সস্ত বাহবা নেয়ার কৌশল হিসেবে হাত দিয়েছিল ‘পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি’তে। অনুসন্ধানের ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করাই ছিল মূল লক্ষ্য। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতিই হয়নি। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একজন উপ-পরিচালক গত বুধবার জানান, আড়াই বছর আগে তিনি ফাইলটি ‘অনিষ্পন্ন অবস্থা’য় রেখে এসেছিলেন। কিন্তু ওই অনুসন্ধানের পরবর্তী অগ্রগতি তিনি জানেন না।
সূত্র মতে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে ‘পানামা পেপার্স’ ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি প্রকাশ করে। আইজিআইজে’র কাছ থেকে প্রাপ্ত এসব নথি বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদ মাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে। প্রচারিত তথ্যে ২ লাখ ১৪ হাজারের বেশি কোম্পানি ও ব্যক্তির নাম উঠে আসে। তারা ‘মোসাক ফনসেকা’ নামক আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পদের তথ্য গোপন করে অপ্রদর্শিত অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে আসে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ‘পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি’র সূত্র ধরে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডুর গুনলাউগসন পদত্যাগ করেন। তালিকায় সরাসরি নাম না থাকলেও পদত্যাগ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল চিলি শাখার প্রেসিডেন্ট গঞ্জালো দেলাভেউ। বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা তদন্ত করতে না দেয়ায় সুইজারল্যান্ডের দুর্নীতি দমন বিশেষজ্ঞ মার্ক পিথও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। অথচ গোপন নথিতে উঠে আসা বাংলাদেশের অর্ধ শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও তাদের কাউকে বিন্দুমাত্র বিব্রত করেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ তাৎক্ষণিক ঘোষণা দেন পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির বাংলাদেশ অংশটির বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর। বিভিন্ন দেশে অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকৃত অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে কি না, এ ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে কি না এটি খতিয়ে দেখবে সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে উপ-পরিচালক এসএম আখতার হামিদ ভুইয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ মে তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানকে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ দেয়া হচ্ছে বলে জানান।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যানের এটিই ছিল শেষ বক্তব্য। এরপর পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও আলোর মুখ দেখেনি অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি। অনুসন্ধানটি ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে অনুসন্ধান কমিটির সদস্যদের সঙ্গে গণমাধ্যমের কথা বলাও নিষিদ্ধ করে দুদক। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য এবং সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই সরকারের অলিখিত ‘পরামর্শে’ বিষয়টির আপাত অনুসন্ধান না করার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
সূত্র মতে, নানা পদ্ধতিতে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে অনেক মহারথির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পানামা পেপার্স’র কেলেঙ্কারির অনুসন্ধানে সেই প্রমাণ একের পর এক বেরিয়ে আসছিল। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছিল সাপ। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ‘সামাল’ দেয়া সম্ভব হবে না কিংবা দায়মুক্তি প্রদান সম্ভব হবে নাÑ এই আশঙ্কা থেকে অনুসন্ধানটি ধামাচাপা দেয়া হয়। কিন্তু বাইরে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয়-পানামা পেপার্সে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়ায় প্রকাশিত অভিযোগটির সারবত্ত্বা পাওয়া যায়নি। অথচ অনুসন্ধানে গঠিত দুদক টিম এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয় যে, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) ও প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
পরবর্তীতে বছরে ১ লাখ কোটি টাকা পাচারেরও তথ্য প্রকাশিত হয়। পানামা পেপার্সে উঠে আসা ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের বাইরেও সরকারি আমলারা এই অর্থ পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অর্থ পাচার সিন্ডিকেটের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। আমলাদের অর্থ পাচারের বিষয়টি পরবর্তীতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যেও সেটির প্রতিফলন দেখা যায়। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত আমলাচক্রের স্বার্থেই ধামচাপা দেয়া হয় আমলা-শাসিত, নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি দমন কমিশন। বিষয়টিকে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে দিতে তথ্য-উপাত্ত হাতে না পাওয়ার তত্ত্ব প্রচার করে প্রতিষ্ঠানটি।
দুদক টিমের হাতে আসা তথ্য মতে, অফশোর কোম্পানির নামে কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচারের তালিকায় একজন সরকারদলীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য রয়েছেন। পরবর্তীতে তার আশীর্বাদপুষ্ট ফরিদপুর নগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পদাক সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং সহোদর ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অন্তত: ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থ পাচারের নেপথ্যে রয়েছে উল্লেখিত প্রেসিডিয়াম সদস্য। পানামা পেপার্সে তার ছেলে, পুত্রবধূ, বোন, ভগ্নিপতি, দুই ভাগ্নের নামও ছিল। তারা বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড অফশোর কোম্পানি ‘এসেস্টস কানেকশন লি:’ নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারা ২০০৮ সালের ১২ মে ‘এল্ডার স্টার’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান কেনেন।
দুদক সূত্রটি আরো জানায়, ‘সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশন প্রা: লি:’র চেয়ারম্যান এবং পাঁচ পরিচালকের বেশকিছু রেকর্ডপত্রও দুদকের হাতে ছিল। ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তিন পরিচালকের অফশোর অ্যাকাউন্টে অর্থ পাচারের তথ্যও ছিল দুদকের হাতে। ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ’র একজন সাবেক সভাপতি, খুলনার পাট ব্যবসায়ী দীলিপ কুমার মোদী, ‘সি পার্ল লাইন্স’র চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, ‘বাংলা ট্রাক লিমিটেড’র মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক, তারিক ইকরামুল হক, ‘ওস্টোর্ন মেরিন’র পরিচালক সোহেল হাসানের রেকর্ডপত্রও দুদকের হাতে আসে। ‘মোমিন টি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজমত মইন, মাসকট গ্রুপের চেয়ারম্যান এফএম জুবাইদুল হক, তার স্ত্রী সালমা হকের তথ্যও হাতে পায় দুদক। ‘সেতু করপোরেশন’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, তার স্ত্রী উম্মেহ রব্বানা, ‘অমনিকেম লিমিটেড’ চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল আলম, তার পুত্রবধূ ফওজিয়া নাজ, আবদুল মোনেম লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মহিউদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী আসমা মোনেম, অনন্ত গ্রুপের শরিফ জাহির, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ বিল্ডার্স’র ক্যাপ্টেন সোহাইল হাসান, বিবিটিএল’র পরিচালক এএফএম রহমাতুল্লাহ বারী, ক্যাপ্টেন এমএ জাউল, মির্জা এম ইয়াহইয়া, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, সেয়দা সামিনা মির্জা এবং জুলফিকার হায়দারের রেকর্ডপত্র হাতে পায় দুদক। এর মধ্যে আজমত মঈন, এফএম জুবাইদুল হক, তার স্ত্রী সালমা হক, মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী, উম্মে রান্নাসহ ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তাদের কাউকেই শেষ পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা হয়নি। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে সবাই দাবি করেছেন, বিদেশে উপার্জিত অর্থই সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ইউরোপে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থই বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড অফশোর কোম্পানিতে লগ্নি করা হয়েছে। অন্য একজন দাবি করেন, এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুসরণের বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও বিনিয়োগ করেছেন। তবে যেহেতু এ উপার্জনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এ দেশ থেকে কোনো অর্থ নেয়াও হয়নি-তাই অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করার প্রয়োজনীয়তাও তারা উপলব্ধি করেননি।
‘পানামা পেপার্স কেলেংকারি’র অনুসন্ধান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদক সচিব ড. মুহা: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, পানামা পেপার্স অনুসন্ধান সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমার জানা নেই। বিষয়টি সম্ভব অনেক আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। পরবর্তীতে আইনের সংশোধনী এসেছে। এ কারণে সব লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান-তদন্তের দায়িত্বও এখন দুদকের নয়।