শাহ মোহাম্মদ
আস্থার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (ই-কমার্স) ইভ্যালি। এতে একদিকে সব গ্রাহক ইভ্যালি থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অপর দিকে তেমনি ইভ্যালিকে সব ধরনের সহযোগিতা থেকে সরে যাচ্ছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ইভ্যালির গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থাৎ ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে কোন ধরনের কেনাকাটা করতে পারবে না। অপরদিকে ব্যাংকের সহযোগিতার অভাবে ইভ্যালির ব্যবসাও অনেকটা থমকে দাঁড়ানোর অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করছে না এমন অজুহাতে সারা দেশের গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে ইভ্যালি। অনেক গ্রাহক বিভিন্ন পণ্যের জন্য ইভ্যালিতে টাকা বিনিয়োগ করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে পড়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার ইভ্যালি ও আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্স সাইট থেকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডট কম বিডি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব অনলাইন মার্কেট প্লেসের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের গণসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ইকরামুল কবীর। তিনি বলেন, এটি ব্র্যাক ব্যাংকের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব থাকবে তা নির্ণয় করে আমাদের পরিচালনা পরিষদ। তারা এই সাইটগুলোতে লেনদেন আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ব্যবসায় নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। নতুন এই ব্যবসা পদ্ধতিতে অনলাইন বাজারগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে কয়েক মাসের অগ্রিম টাকা সংগ্রহ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য সরবরাহ করতে আরও বেশি সময় নিয়ে থাকে। এছাড়া, প্রায়ই তারা ক্রেতাদের জানিয়ে দেয় যে, তাদের অর্ডার করা পণ্যগুলো শেষ হয়ে গেছে। আর তাই সেটা পাঠানো সম্ভব নয়। তবে, মাসের পর মাস অপেক্ষার পরেও প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে ক্রেতারা তাদের টাকা ফেরত পান না বলে অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। অনলাইন ক্রেতাদের লোভনীয় সব ছাড়ের ফাঁদে ফেলে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংকও।
অনিয়ন্ত্রিত এসব ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে উচ্চ লেনদেনের বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ক্রেতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত অগ্রিম অর্থের বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পদ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (ই-কমার্স) ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেলের একটি ফেসবুক পোস্টে অভিযোগের বন্যা বয়ে গেছে। ই-কমার্স সাইটটি সময়মতো পণ্য সরবরাহ বা অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মন্তব্যের ঘরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বেশিরভাগ গ্রাহক।
মাহবুবুর ইসলাম নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক পোস্টটিতে অভিযোগ করে মন্তব্য করেছেন, ‘একটি পণ্য ডেলিভারি দিতেই যদি আপনাদের ১২০ দিন লাগে, তাহলে ৪৫ দিনে ডেলিভারি দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন কেন? কথা যদি না-ই রাখতে পারেন, তাহলে কথা দিয়েছিলেন কেন?’
ইভ্যালি লাভ করছে বলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল ফেসবুক পোস্টে দিলে সেখানে অভিনন্দন জানানোর বদলে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন মাহবুবুর ইসলামসহ আরও অনেকে। অনেক মন্তব্যকারী কোম্পানির লাভের কথা ফেসবুকে বলে বেড়ানো বন্ধ করে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে বলেন মোহাম্মদ রাসেলকে।
রুবেল আহমেদ নামে এক গ্রাহক মন্তব্য করে বলেন, তিনি ২০২০ সালের জুলাইয়ে একটি বাজাজ মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। সেই অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ার ১১ মাস পর তিনি তার পরিশোধকৃত টাকা ফেরত পান।
রুবেল জানান, ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি ইভ্যালি থেকে তাকে ফোন করে জানানো হয় যে, ৭ দিনের মধ্যে তিনি রিফান্ড পেয়ে যাবেন। কিন্তু ১০দিন পেরিয়ে গেলেও তিনি টাকা ফেরত পাননি। এরপর তিনি ইভ্যালিতে ইমেইল পাঠান। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার পাননি। তারপর তিনি প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে এ নিয়ে পোস্ট করেন।
রুবেল লেখেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে ইভ্যালি থেকে আমাকে ফোন করে জানায় যে আমার টাকা রিফান্ড করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি এসএসএলকমারজ-এর সাথে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে জানায় যে, তারা কোনো রিফান্ড পায়নি।’
খায়ের সরকার নামে আরেকজন গ্রাহক চারটি ইনভয়েসের বিস্তারিত দিয়েছেন। ১৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও তাকে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। খায়ের লেখেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত পাঁচবার এ সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করেছি। কিন্তু গত ৩৯ দিন ধরে কোনো খবর পাইনি।’
বর্তমান পরিস্থিতে মনে হচ্ছে, ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী বারবার আশ্বস্ত করার পরও সময়মতো পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড না করায় প্রতিষ্ঠানটির ওপর গ্রাহকদের বিশ্বাস কমে গেছে।
আনিসুজ্জামান রাসেল নামে আরেকজন ক্ষুব্ধ গ্রাহক লিখেছেন, ‘আমার এপ্রিল মাসের অর্ডারের সমস্যার সমাধান করতে পারেননি এখনও। তারপরও নিজেদের কীভাবে বাংলাদেশের সেরা ই-কমার্স সাইট দাবি করেন?’ আহসানুল কবির দিদার নামে আরেক গ্রাহক ২০২০ সালের ২২ জুনের একটি ইনভয়েস পোস্ট করে বলেন, ‘ঠিক এক বছর আগে এই অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু সেটি বাতিল হয়ে যায়। তাই আমার রিফান্ড পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক বছর পরও আমি কোনো রিফান্ড পাইনি।’
আরও অনেক গ্রাহক ইনভয়েসের ছবি দিয়ে জানতে চেয়েছেন তারা পণ্য কবে পাবেন। কিংবা রিফান্ড কবে দেওয়া হবে। কিন্তু এসব মন্তব্যের বেশিরভাগেরই উত্তর দিয়েছেন ইভ্যালির কর্মচারীরা। ক্ষুব্ধ গ্রাহকদের ধৈর্য ধরতে বলে লিখেছেন সমস্যাগুলো নিয়ে তারা কাজ করছেন।
মামুনুর রশিদ নামে এক গ্রাহক রাসেলের পোস্টের নিচে মন্তব্য করেছেন, ‘একের পর এক অর্ডার নেওয়ার নাম ব্যবসা না। পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে শুধু টাকা নেওয়ার নাম ব্যবসা না। ব্যবসা নির্ভর করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টির ওপর। সেটা নিশ্চিত করতে না পারলে ইভ্যালি শীঘ্রই হোঁচট খাবে।’
প্রথমে সময়মতো পণ্য না পাওয়ার ব্যাপারে শত শত গ্রাহকদের অভিযোগ, তারপর ইভ্যালির ধসে পড়ার অনিবার্য ঝুঁকির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক তাদের কার্ড ব্যবহার করে ইভ্যালি ও আরও কয়েকটি ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা করতে নিষেধ করেছে। এতে ইভ্যালির ব্যবসায় ধস নামার ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
তবে ইভ্যালিতে ধস নামার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল। তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, ইভ্যালি সঠিক পথেই আছে এবং তারা প্রাথমিক দেনা শোধ করে শীঘ্রই ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন।
« পূর্ববর্তী সংবাদ