শাঈখ মুহাম্মাদ উছমাআল কুরআন বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কালাম বা বাণী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে। সে দায়িত্ব যেন মানুষ সঠিকভাবে প্রতিপালে সক্ষম হয় সে জন্য পাঠিয়েছেন নবী ও রাসূল, নাজিল করেছেন কিতাব।
প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদি পিতা আদম (আ.) থেকে নূহ (আ.)-এর পূর্ব পর্যন্ত নবীগণ (তাকভিনিয়াত) সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান চর্চা করেছেন অধিক হারে। হজরত নূহ (আ.) থেকে শুরু করে (তাশরিইয়াত) বিধিবিধান ব্যাপকতা লাভ করে।
আল কুরআন কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়; কিন্তু এতে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের তথ্য ও তত্ত্ব। আল কুরআন কোনো সাহিত্যকর্ম নয়; কিন্তু এতে রয়েছে সাহিত্যের সব রসদ। আল কুরআন কোনো গল্প-উপন্যাস নয়; কিন্তু এতে রয়েছে জগতের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক কাহিনি।
আল কুরআন কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়; কিন্তু এতে রয়েছে কালোত্তীর্ণ অমর মহাকাব্যের সব ধরনের উপাদান। আল কুরআন জীবন্ত মুজিজা।
মানুষের জীবন চলার পথে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ইতিবাচক ও কল্যাণকর রূপে ব্যবহারের পরিশীলিত সুবিন্যস্ত জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান। আল কুরআন শ্রেষ্ঠতম মহাবিজ্ঞান। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কুরআনে কারিমে বলেন-‘শপথ বিজ্ঞানময় কুরআনের।’ (৩৬:২)।
কুরআনে হাকিমের প্রথম অবতীর্ণ পঞ্চ আয়াতেও তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে : ‘পড় তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়; আর তোমার রব মহীয়ান; তিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেছেন, মানুষকে তা শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (৯৬:১-৫)।
বিজ্ঞানীরা তাদের নানা আবিষ্কারে কুরআন থেকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন; তাদের তথ্য ও তত্ত্বগুলো কুরআনিক সূত্রের অনুকূলে এসেছে। বিশ্বের বহু সেরা সেরা বিজ্ঞানী কুরআন পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
যেমন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলী, যিনি ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক একটি বই লিখেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো ও কুরআন পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ। এতকাল যেসব আয়াতের ব্যাখ্যা করা কঠিন ছিল, আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমাদের সেসবের অর্থ বোঝার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। আল কুরআনের বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো প্রমাণ করে এটি আসমানি কিতাব।
আল কুরআনে রয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞান সব মৌলিক বিষয়। যেমন- জ্যোতিষ শাস্ত্র, বিশ্ব সৃষ্টি ও মহাবিস্ফোরণ (বিগ ব্যাংগ) প্রসঙ্গ, ছায়াপথ সৃষ্টির আগে প্রাথমিক গ্যাস পিণ্ড, পৃথিবীর আকার গোল। আছে পদার্থবিজ্ঞান, পানিবিজ্ঞান, পানিচক্র, বাষ্পে পরিণত হওয়া। আছে ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞান, পাহাড় পর্বতের রহস্য, মহাসাগর, মিষ্টি ও লবণাক্ত পানির বিবরণ এবং রয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞান। রয়েছে প্রাণিবিজ্ঞান, পাখির উড্ডয়ন, মৌমাছির দক্ষতা, মাকড়সার জাল, পিপিলিকার জীবনধারা ও যোগাযোগ। আছে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ওষুধ ও পথ্য। রয়েছে শরীরতত্ত্ব, রক্ত চলাচল, দুগ্ধ ও ভ্রূণতত্ত্ব এবং সাধারণ বিজ্ঞান ও আঙুলের ছাপ ইত্যাদি।
ভ্রূণতত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের জটিলতম একটি বিষয়। আল কুরআনে ভ্রূণ সৃষ্টি ও এর বিকাশ সম্পর্কিত যথাযথ বর্ণনা রয়েছে। ‘আমি তো মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি, পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে, অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপিঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দিই, অবশেষে তাকে রূপ দান করি। সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কেয়ামতের দিন তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে। আমি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সাজিয়েছি, অমি সৃষ্টির বিষয়ে বেখবর নই।’ (২৩:১২-১৭)।
কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, শীর্ষস্থানীয় ভ্রূণতত্ত্ববিদদের অন্যতম কিথ মুর, কুরআনের এসব বক্তব্য ও সহিহ হাদিসের বিবরণ সম্পর্কে বলেন, ‘উনিশ শতক পর্যন্ত, মানবীয় বিকাশের ধাপগুলো সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। উনিশ শতকের শেষ দিকে বর্ণমালার প্রতীকের ওপর ভিত্তি করে মানব ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিত করা হয়।
ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং ফিলাডেলফিয়ারটমাস জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল বাও ইনস্টিটিউটের পরিচালক মার্শাল জনসন বলেন, ‘বিজ্ঞানী হিসাবে আমি ভ্রূণতত্ত্ব এবং ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বুঝতে পারি। আমাকে যদি আমার আজকের জ্ঞান ও বর্ণনার যোগ্যতাসহকারে সেই যুগে স্থানান্তর করা হয়, কুরআনে যে বর্ণনা রয়েছে সেভাবে বর্ণনা করতে পারব না।’
আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম সাফল্য মহাকাশবিজ্ঞান। এ বিষয়ে আল কুরআনে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং জীবন্ত সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?’ (২১:৩০)। এটি আধুনিক বিজ্ঞানের ‘বিগ-ব্যাং’ তত্ত্বের অনুরূপ। পানি থেকে জীবন সৃষ্টির উল্লেখ হয়েছে এটিও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক। সব জীবিত প্রাণী প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরি, যার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই পানি।
অধুনা বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাজগৎ সদা সম্প্রসারণশীল। এ প্রসঙ্গটিও আল কুরআনে রয়েছে- ‘আমি আমার ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সম্প্রসারিত করছি।’ (৫১:৪৭)।
মহাবিশ্বে সবকিছুই ঘূর্ণায়মান বা চলমান। এ বিষয় সম্পর্কে আল কুরআনের বর্ণনা : ‘আল্লাহই দিন ও রাত করছেন, সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র ও সূর্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গতিতে কক্ষপথে সন্তরণ করছে।’ (৩৬:৩৮-৪০)। ‘তিনিই সূর্যকে তেজষ্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার তিথি নির্দিষ্ট করেছেন।’ (১০:৫)। কুরআনে সূর্যকে ‘সিরাজ’ বলা হয়েছে যা স্বীয় আলো, আর চন্দ্রকে ‘নূর’ বলা হয়েছে যা অন্য উৎস থেকে ধার করা। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞান প্রসঙ্গে আল কুরআনে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে-‘আমি কি ভূমিকে বিছানা ও পর্বতকে কীলক সদৃশ করিনি?’ (৭৮:৬-৭)।
কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন ও এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান টিভিএন পারসাদ বলেছেন-‘মুহাম্মাদ একজন সাধারণ লোক ছিলেন, তিনি পড়তে জানতেন না, লিখতে পারতেন না, তিনি নিরক্ষর ছিলেন। আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছি তা হলো চৌদ্দশ বছর আগে এ নিরক্ষর লোক এমন গভীর কিছু উচ্চারণ করেছিল, যা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক। এতে অসংখ্য সঠিক ব্যাপার রয়েছে, আমার মনে কোনো সংশয় নেই এ সত্য স্বীকার করতে যে কোনো ঐশী প্রেরণা বা ওহি তাঁকে এই বক্তব্যগুলো দিতে নির্দেশ দিয়েছে।’
কুরআন মহানবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠতম মুজিজা মহান আল্লাহর কুদরতের মহানিদর্শন। ‘আমরা তাদের আমাদের নিদর্শন দেখাব দূরদিগন্তে এবং তাদের মধ্যে যতক্ষণ না তারা জানতে পারে যে, এটাই সত্য।’ (৪১:৫৩)। কুরআন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কেয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ‘তারা কি সূক্ষ্মভাবে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না, যদি এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছ থেকে হতো, তারা এতে বহু অসামঞ্জস্য খুঁজে পেত।’ (৪:৮২)।
লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্কলার্স ফোরাম বাংলাদেশ
ন গনী